Skip to main content

ফতুয়া

মোহনবাবু রোজকার অভ্যাস মতই দিব্যি পায়চারি করছিলেন বাড়ির সামনের অন্ধকার গলিটায়। রাতে খাওয়ার পর একটু হাঁটাহাঁটি করলে ডাইজেশন ত্বরান্বিত হয়। এর মাঝে হঠাৎ কেন যে  পকেট থেকে সিগারেটের বাক্সটা বের করে একটা গোল্ডফ্লেক ঠোঁটে ঝোলাতে গেলেন।

ঠোঁটের ঝুলন্ত সিগারেটের ডগা তো আর ফস্‌ করে আপনা থেকে জ্বলে যাবে না। দেশলাই চাই। কিন্তু পকেটে দেশলাই নেই। অবশ্য পকেটে দেশলাই নেই বলে চিন্তা হচ্ছে না। মোহনবাবুর কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ অন্য কারণে। সিগারেটের প্যাকেট তাঁর পকেটে এলো কী করে? সিগারেটের ধোঁয়া যে তাঁর অসহ্য লাগে।

সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে শুরু হয়েছিল। তারপর তিন দিন ধরে থেকে অচেনা রুমাল, বোরোলিনের টিউব, নস্যির ডিবে; এমন অসংখ্য খুচরো জিনিসপত্র মোহনবাবুর ফতুয়ার বাঁ পকেটে এসে জমা হওয়া শুরু হল। আচ্ছা ফ্যাসাদ। মোহনবাবুর বুকে সর্বক্ষণ ঢিপঢিপ, এই বুঝি ফের উটকো কিছু তাঁর পকেটে এসে উদয় হলো।

মোহনবাবু ফতুয়া পরা ছেড়েই দিলেন। বলা বাহুল্য, যে ছাড়তে বাধ্য হলেন। দু'টো দশটাকার নোট, ক্যারমের স্ট্রাইকার, হোমিওপাতির শিশি পর্যন্ত ঠিক ছিল। সেদিন দুপুরে ছাতে পায়চারি করার সময় আচমকা ফতুয়ার বাঁ পকেট থেকে বেরোলো একটা পোস্টকার্ড। "প্রাণের মৃন্ময়ী" বলে লেখা। হাতের লেখা গোলমেলে, তবে পড়তে অসুবিধে হয় না। প্রেমিক জানাচ্ছেন যে মৃণ্ময়ীকে না পেলে তিনি আত্মহত্যা করবেন। মৃণ্ময়ীদেবীর ঠিকানাও লেখাই ছিল কিন্তু পোস্ট করা হয়নি। একবার ভাবলেন এই মৃন্ময়ী সান্যালের বাড়ি পর্যন্ত গিয়ে তদন্ত করে আসবেন। তারপর ভাবলেন "ধুর ছাই কাঁচকলা"। চিঠিটাকে তোষোকের তলায় কবর দিলেন মোহনবাবু। আর সেদিন থেকে ফতুয়া পরা ছাড়লেন। স্রেফ হাফ শার্ট। রাতে শোয়ার সময় স্যান্ডো গেঞ্জি।

কিউরিওসিটি কিল্‌স দ্য ক্যাট। ফতুয়াহীনতার তিন নম্বর দিনে আর কৌতূহল দমন করতে পারলেন না মোহনবাবু। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে হাত মুখ ধুয়ে অফিসের জামা কাপড় ছেড়েই লুঙ্গির সঙ্গে গায়ে চাপালেন তাঁর পছন্দের নীলে হলুদ ফুল ফুল ছোপের ফতুয়া। গড়িয়াহাটের ফুটপাথ থেকে কেনা। আধ ঘণ্টার বেশি অপেক্ষা করতে হল না। বাঁ পকেট থেকে এবার বেরোলো মানিব্যাগ। মানিব্যাগে ভিজিটিং কার্ড আর কোম্পানি আই কার্ড। ভাস্কর সামন্ত। বাড়ি গড়িয়া।

ভাস্করবাবু বেশ ঘাবড়ে গেলেন ফোনটা পেয়ে। কোথাকার কে মোহন দত্ত! সে জানলে কী করে যে তাঁর সিগারেট, নস্যির ডিবে, ক্যারমের স্ট্রাইকার হারিয়ে যাচ্ছে ? হারিয়ে যাওয়া মৃণ্ময়ীকে লেখা চিঠিটাই বা ও পেল কী করে? অবিশ্বাস করার কারণ নেই, পুরো চিঠিটা পাঠ করে শুনিয়েছেন সে ভদ্রলোক।

মোহন দত্তের সঙ্গে দেখা করে সবচেয়ে ভালো ব্যাপার যেটা হল সে'টা হচ্ছে যে এদ্দিনের ধন্দটা কেটে গেল। গোটা  ব্যাপারটা এখন ভাস্করবাবুর কাছে জলবৎ । যাক্‌। ফতুয়ার ডান পকেটে জিনিস রাখা মাত্রই হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা মোটেও ভালো ঠেকছিল না। যা হোক, ব্যাপারটা এইবার সাফ। তবে এই মোহন দত্ত লোকটা বিশেষ সুবিধের নয়। মৃণ্ময়ীকে লেখা চিঠিখানা পুরোটা পড়ার সাহস ও পায় কোথা থেকে?

মাঝেমধ্যেই এই ভূতুড়ে ব্যাপারটা আজকাল ঘটছে। মৃণ্ময়ী বুঝে উঠতে পারছে না এটা কেন হচ্ছে। এটা কি কোনও ব্যামো? কে জানে। তবে দুমদাম করে তার চোখের সামনে দিয়ে খুচরো সব জিনিস মুহূর্তের জন্য ভেসে যাচ্ছে। হুশ্‌ করে উদয় হয়ে ফুস্‌ করে গায়েব হয়ে যাচ্ছে। অনবরত। কখনও বোরোলিনের টিউব, কখনও সিগারেটের বাক্স, কখনও পোস্টকার্ড। মাঝে দু'তিনদিন বন্ধ ছিল। কিন্তু আজ আবার মৃণ্ময়ীর চোখের সামনে দিয়ে একটা মানিব্যাগ সাঁইসাঁই করে উড়ে চলে গেল। মানিব্যাগের চামড়ার রঙ আবার ক্যাটক্যাটে খয়েরী। ভাস্করের মানিব্যাগটার কথা মনে পড়ে গেল মৃণ্ময়ীর। ভাস্কর এমন ভাবে চুপ করে গেল কেন? এই তাঁর ভালোবাসা?

মৃন্ময়ী নামটা কিছুতেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছিলেন না মোহনবাবু।

১০
ভাস্করবাবু জানেন যে তাঁর চোখ তাঁকে ঠকাবে না। কোয়ালিটি রেস্টুরেন্টের কেবিনে যার গায়ে বারবার হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ছিলো মৃণ্ময়ী, সে যে ওই মোহন দত্তই, সে'টা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই ভাস্করবাবুর। ছ'টা টেবিল দূরে বসেও ব্যাপারটা তাঁর কাছে দিনের আলোর মত স্পষ্ট।

১১
টিউবলাইটের ফেলে দেওয়া লম্বা নলের মত প্যাকেটটা কুড়িয়ে নিয়ে একটা ম্যাজিক সুড়ঙ্গ বানিয়েছিল বিট্টু। আর সেই সুড়ঙ্গের এক দিকে চোখ রেখে অদ্ভুত সব জিনিষ পত্রের ছুটে চলা দেখতে পারত সে। কী দারুণ। কোনও দিন নস্যির ডিবে, কোনও দিন ক্যারমের হলুদ স্ট্রাইকার। কোনও দিন পুরনো দশটাকার নোট, এমন কত কী।  সবকিছু বিট্টুর ম্যাজিক নলের মধ্যে ছুটে বেড়াতো। একদিন একটা বেঢপ খয়েরী মানিব্যাগও দেখতে পেয়েছিল সে। এ'টা কাউকে বলেনি বিট্টু, বাবা মাকেও না। ও জানতো ওর কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। শুধু যে'দিন সাপটাকে দেখা গেছিল সেই যাদু সুড়ঙ্গে, সে'দিন সেই টিউবলাইটের কাগুজে প্যাকেট ফেটে সুড়ঙ্গ নষ্ট হয়ে গেছিল। সাপের ছটফটে বোধ হয়।

১৩
মোহনবাবু আর মৃণ্ময়ী দু'জনেরই মারা যাওয়ার কথা ছিল; যন্ত্রণায় বুক ফেটে। কিন্তু বিচিত্র জীবন। যন্ত্রণা বুকে নিয়ে টিকে থাকতে হল দু'জনকেই। এক মাত্র ছেলেটা শেষ পর্যন্ত সাপের কামড়ে মারা গেল? বিট্টুর ঘরে ওই বিষাক্ত কেউটে এলোই বা কী করে?

১৪
কালী সাপুড়ে সুনাম বদনাম দুইই আছে।  ওই কালকেউটেকে ছোঁয়ার সাহস ভাস্করবাবুর হয়নি। কালীই ঢুকিয়ে দিয়েছিল ভাস্করবাবুর ডান পকেটে। আর ম্যাজিকের মত, পকেটে পড়তেই সে সাপ গায়েব।

১৫         
কেউটেটা জলে যাওয়ার খুব আঘাত পেয়েছিলেন ভাস্করবাবু। তিনদিনের মাথায় ফের সেই কেবিনেই ওদের আবার দেখতে পাওয়া। ঢলাঢলি বেড়েছে বই কমেনি। সেদিন রাত্রের ট্রেনেই কলকাতা ছেড়ে হাঁফ ছেড়েছিলেন ভদ্রলোক।  

Comments

Unknown said…
দারুণ....

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু