Skip to main content

কলকাতার মেসিয়াহ্ - চতুর্থ পর্ব

দোতলার জানালা দিয়ে দেখা যায় এক ফালি গলি যা ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ভেসে ভেসে হ্যারিসন রোডে গিয়ে মিশছে।

রাত পৌনে তিনটে। ঠিক এই সময় বেড়ালটা এসে বসে মেসবাড়ির দরজাটার সামনে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ওর ছায়া চারগুণ হয়ে গলিতে ছড়িয়ে পড়ে। নিবিষ্টমনে নিজের ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে সাদায় বিস্কুট মেশানো বেড়ালটা। স্থিতধী, অবিচল। লেজটা একটা নির্দিষ্ট অ্যাঙ্গেলে পাকানো থাকে, ডগাটা মাঝেমধ্যে নড়ে ওঠে শুধু। নড়ে ওঠাটা বোধহয় চিন্তার বাড়তি কিলবিল।

দোতলার ঘরের পূবের দিকের দুটো বেডের মাঝে যে জানালা, সে'টা দেড় মানুষ সমান - মেঝে পর্যন্ত নেমে এসেছে। উপরে দু'টো, নীচে দু'টো বেঢপ সাইজের পাল্লা।
তার শিকে মাথা ঠেকিয়ে অরূপ একমনে বিড়ালটার দিকে তাকিয়ে থাকে। রুমের বাকি তিনজনের মধ্যে একজন ঘুমিয়ে কাদা, অন্য দু'জন অজয়দার ট্যুয়েন্টি নাইনের মজলিসে। অজয়দার রুম থেকে মাঝেমধ্যেই টেবিল চাপড়ানো আস্ফালন আর খিস্তির রিলে ভেসে আসছে।

অন্য রুম থেকে মিহি এফ এমের সুর ভেসে আসছে। আলটপকা হিন্দী গান। দু'টো শিকের মাঝে নাক আর একটা গাল চেপটে বেড়ালটার দিকে তাকিয়ে থাকে অরূপ।

রাতের কলকাতার একটা নেশা আছে, সে নেশার গন্ধ এ জানালার ফিল্টার দিয়ে অরূপের বুকে এসে পড়ে রোজরাতে।

ক্রমশ অরূপের দৃষ্টি স্থির হয়ে আসে। গলি, ল্যাম্পপোস্ট,  বেড়াল, বেড়ালের ছায়া,  হ্যারিসন রোড সমস্ত মিলেমিশে থেবড়ে যায়।

সেই থেবড়ে যাওয়া আবছায়া থেকে মাথা নাড়া দিয়ে ওঠে পাড়া, পাড়ার ক্লাব, স্কুলের মাঠ, ঝিমলি,  বাড়ি, বাড়ির ছাদ, ঠাকুমার পান ছেঁচা, মা। মা।

অরূপ বড় হতে হতে একটা সহজ ব্যাপার ঠাউরেছে যে মা আর যাই হোক পারফেক্ট নয়। আর সে জানাটা যত বাড়ছে, মায়ের প্রতি কান্না তত জমা হয়। সেই কদ্দিন আগে মানুষটা বিয়ে করে সব ছেড়েছুড়ে চলে আসে। মা হারমোনিয়াম ছেড়েছে। জেন্ডার ইকুয়ালিটি নিজের হাতে বঁটিতে কুচিয়েছে। মা সত্যিই ভীতু ; পরিবারের সুনাম বদনামের ভয়, বাবার শরীরের ভালোমন্দর ভয়, অরূপের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা। মায়ের অব্যবহারের হারমোনিয়ামের বাক্সের জন্য বাড়ির কার্পেট এরিয়া কমে যাচ্ছে বলে বাবা মাঝেসাঝে বিরক্তি প্রকাশ করেন। মা সমস্ত বিরক্তি শুষে নিতে পারে। মা পারফেক্ট হলে গান হারাতে দিত না। ইম্পার্ফেকশন বড় মায়াবী।  অরূপের বুকে "মা মা" ডাক কুণ্ডলী পাকায়।

- "অরূ, তোর কাছে লোটাকম্বল দেখেছিলাম না"? বল্টেদার ডাকে সম্বিৎ ফেরে। বিড়ালটা যেন অরূপের কনসেন্ট্রেশনের জোরেই আটকা পড়েছিল। অরূপের দৃষ্টির ফোকাস সরতেই সেও লেজ গুটিয়ে হাওয়া।

- "সঞ্জীব তোমার মেলোড্রামাটিক লাগে বলেছিলে না? আজ এই অসময়ে"?

- "অফ কোর্স। মেলো বলে মেলো। মেগা মেলো। আসলে বালিশটা ঠিক সাফিশিয়েন্টলি মোটা নয়। ঘাড়ে ব্যথা হচ্ছে। তোর লোটাকম্বলের যা থিকনেস দেখেছি...পারফেক্ট গ্যাটিস হয়ে যাবে"।

- "বইয়ের তাক। নীচের শেল্ফ। হানিফের অ্যাকাউন্টেন্সি বইটার নীচে"।

- "থ্যাঙ্কস, কালই ফেরত পেয়ে যাবি"।

- "তোমার বালিশ আমি কাল রোদে দিয়ে দেব"।

- "হেহ্, গুড নাইট"।

Comments

Unknown said…
এরপর আর আগায় নি কেন। ক্যারেক্টারগুলো বেশ জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বাকি পর্ব গুলো কষ্ট হলেও লিখে ফেলুন। গল্পের শেষটা না জানলে, জল খেয়েও পিপাসা না মেটার মতো অস্বস্তি থেকে যায়।

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু