Friday, January 13, 2017

অজিত সেনগুপ্তর খুন

- আচ্ছা বটুবাবু, এমন ম্যাদা মেরে আছেন কেন বলুন তো? কেসটা ফাঁপরে ফেলেছে বেশ?

- ইন্সপেক্টর সাহেব, কেস সলভ করা আপনার দায়। সে নিয়ে দুশ্চিন্তাও আপনার। তবে আমার মন মেজাজ সত্যিই তেমন ভালো নেই। বাহাত্তর নম্বর ফুচকাতেই ঢেঁকুর উঠে গেল আজ বিকেলে। বয়স হচ্ছে বোধ হয়, লোহা হজম করা পেট অল্পেই কেঁপে উঠছে।

- তবে যাই বলুন। সেনগুপ্তার মার্ডারটা ভোগাবে মনে হচ্ছে।

- অবিশ্যি ফুচকা সেশনের আগে এক প্লেট ফিশ ফিঙ্গার খেয়েছিলাম বটে। তবে তাই বলে ফুচকায় হান্ড্রেড হিট করব না, এ'টা বরদাস্ত করা যায়?

- বটুবাবু, সেনগুপ্তার মার্ডার। কেসটা বড় জটিল। একটু ফোকাস করুন প্লীজ। এ বছর খুব এক্সপেক্ট করছিলাম প্রমোশনটা।

- নাকি ডিফেক্ট ফুচকাতেই ছিল? টকটা অপ্টিমাইজ করতে পারেনি বলেই কি এই বিপত্তি?

- সামনের সিজনে জুড়ে প্রতি হপ্তায় অন্তত তিন দিন আপনার বাড়িতে এক কিলোর বেশি সাইজের ইলিশ পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমার।

- ফার্ন রোডের সেনগুপ্ত পরিবার। বিজনেস টাইকুন। প্রবল প্রতিপত্তি। সে'খানে খুন।

- এইত্তো। আসুন, গোল্ডফ্লেক্।

- নাহ্। আমার নস্যিই ভালো। যা বলছিলাম। ফার্ন রোডের সেনগুপ্ত পরিবার। চারটে কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি। তিনটে কলকাতায়, একটা আসানসোলে। সিনিয়র সেনগুপ্ত গত হয়েছেন বছর দশেক হল। ভদ্রলোকের চার ছেলে। অমিত, অনুপ, অজয় ও অজিত। চার জনেই কেমিস্ট্রি নিয়ে রীতিমত পড়াশুনো করে  ব্যবসায় ঢুকেছে। কেউই বিয়েথা করেনি। ব্যবসা, চ্যারিটি আর খাওয়াদাওয়ায় দিন কেটে যায় এদের।

- এবং ব্যবসার ওদের বেস্পতি তুঙ্গে।

- করেক্ট। এ'বার, আচমকা। বলা নেই, কওয়া নেই, সর্বকনিষ্ঠ অজিত খুন হল।

- আর এমন পিকিউলিয়ার ভাবে খুন হলে যে আমাদের নাকে দড়ি। এমন এক কেমিক্যাল যার ট্রেস খুঁজে পেতে কাল ঘাম ছুটে গেল। এখনও ডিকোড করা যায়নি সে অদ্ভুত কেমিক্যালের কম্পোজিশন। শুধু জানা গেছে যে সে কেমিক্যাল ব্লাড স্ট্রিমে একবার ঢুকলে...।

- আধ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু। অবধারিত। কেমিক্যাল টাইকুনদের ফ্যামিলিতে বিষাক্ত কেমিকাল প্রয়োগে খুন, এত সোজাসাপটা কেস্ নিয়ে এত ভাবছেন কেন ইন্সপেক্টর বাবু?

- বেশ। যদি ধরেই নিই যে অজিতবাবুকে খুন করেছেন তারই তিন ভাইয়ের মধ্যে কেউ; অর্থাৎ অমিত, অনুপ বা অজয়। সে ক্ষেত্রে মোটিভ কী?

- টাকা ডেফিনিটলি নয়। যা সম্পত্তি আছে, সে'টা ডিভাইডেড বাই ফোর করলেও প্রচুর। এদিকে চার জনেই ব্যাচেলর। ইনভেস্টিগেশনে যেটুকু জানা যাচ্ছে যে সাংসারিক গোলযোগ বিশেষ ছিল না।

- তবেই বুঝুন, কী জট পাকানো ব্যাপার।

- নিজেদের জবানবন্দীতে তিন দাদাই বলেছে যে অজিতবাবু আজকাল বখে যাচ্ছিলেন। সেদিকটা খতিয়ে দেখেছেন ইন্সপেক্টর সাহেব?

- অবশ্যই। তবে শুনে রাখুন, ভদ্রলোকের তিন দাদাই এটা বলে ইনভেস্টিগেশনকে অকারণ পেঁচিয়েছেন।

- মানে? বখে যাওয়ার খবরটা ভুয়ো?

- তা নয়তো কী? রেসের মাঠ, পাব, রেডলাইট এরিয়া; এমন কোনও জায়গাতেই অজিতবাবুর যাতায়াত ছিল না। প্রেমটেম থেকে শতহস্ত দূরে থাকার মানুষ ছিলেন, সেটাও স্পষ্ট। উলটে রিসেন্টলি বরং ভদ্রলোকের ধর্মে মতি হয়েছিল। দীক্ষাও নিয়েছেন সদ্য। অতএব অনেক ইনভেস্টিগেট করেই বলছি, ওই বখে যাওয়ার গল্পটা ফালতু।

- গাছে উঠলেন, ডালে ঝুলে দোলও খেলেন অথচ হিমসাগর না পেড়েই নেমে পড়লেন ইন্সপেক্টর সাহেব।

- মানে?

- খেটে তদন্ত করলেন, শুধু শেষটুকু পর্যন্ত ধৈর্য রাখতে পারলেন না।

- কীরকম?

- বখে যাওয়ার ডেফিনিশনটা সবার কাছে একরকম নয় দারোগাশ্রেষ্ঠ বটব্যালবাবু। অজিতবাবু হয়ত তাঁর দাদাদের হিসেবে সত্যিই বখতে শুরু করেছিলেন।

- হাউ? কইসে? কী'ভাবে?

- দীক্ষা নেওয়ার ফলে একটা গোলমেলে দিকে পা বাড়িয়েছিলেন তিনি। ভদ্রলোক আমিষ ছেড়ে দিয়েছিলেন।

- নিরামিষ খাওয়াওটা বখে যাওয়া?

- সেনগুপ্ত ফ্যামিলির ডিএনএ'তে আমিষলিপ্সা মিশে আছে। সে'টা ওদের বাবুর্চিদের সঙ্গে সামান্য কথা বললেই জানতে পারতেন। ইন ফ্যাক্ট, ওদের হেড বাবুর্চি বাবুলালকে দু'শো টাকা ঘুষ দিলে আপনাকেও সে সুড়সুড় করে বলে দিত যে কী'ভাবে পরিবারের ট্র‍্যাডিশনের বিরুদ্ধে গিয়ে অজিতবাবুকে গোপনে পনীর সাপ্লাই দিত সে।

- পনীরকে গোপনে খেতে হত?

- অনেককে যেমন গোমাংস ভক্ষণ মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে, সেনগুপ্তদের তেমনই পনীরে কাঁপুনি আছে।

- সে জন্যেই বুঝি আপনি সেদিন বলা নেই কওয়া নেই জেরার সময় এক বাটি পনীরের পকোড়া এনে সেনগুপ্তা ব্রাদার্সদের সামনে রেখে দিয়েছিলেন বটুবাবু?

- আশা করি আপনার মনে আছে যে সে পনীর পকোড়ার বাটি দেখে তিন সেনগুপ্তর মুখই কেমন শুকিয়ে গেছিল।

- একদম!

- আচ্ছা, অজিতবাবু যে রাত্রে খুন হন, পরের দিন সকালে ওর ঘর জরীপ করার সময় ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে দু'টো প্রমাণ সাইজের পাঁঠার পাঁজরা আবিষ্কার হয়। সে'টা দেখে আপনার খটকা লাগেনি?

- উনি রাতের খাওয়া নিজের ঘরে এনে খান। তার আগের রাত্রে বিরিয়ানি হয়েছিল। সহজ ব্যাপার।

- বিরিয়ানি ভক্ত কেউ পাঁঠার পাঁজরা ফেলে দেয়? অমন রসালো!

- নিরামিষ খাওয়া মানুষ, মাটন রিজেক্ট করতেই পারেন।

- তাহলে তাঁকে দেওয়া হবে কেন মটন বিরিয়ানি?

- কারণ...কারণ...নিশ্চই অজিতবাবু নিজের দাদাদের থেকে লুকোতে চাইতেন যে উনি পাঁঠা খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন।

- বাহ্, এইত্তো চমৎকার ভাবে প্রমোশনের দিকে এগিয়ে গেলেন অনেকটা। অর্থাৎ বাড়ির লোক তার নিরামিষ খাওয়া নিয়ে প্রবলভাবে অসন্তুষ্ট ছিলেন। আর তিনি সেই অসন্তোষকে ডজ করে পাশ কাটানোর চেষ্টা করতেন।

- বেশ। কিন্তু খুনটা হল কেন? কী করে?

- মারা যাওয়ার রাত্রে যে প্লেট থেকে অজিতবাবু ডিনার করেছিলেন, সেই থালা পরদিন ভোর পর্যন্ত এঁটোই পড়েছিল। সে'টা পরীক্ষা করেছিলেন?

- তাতে বিষ ছিল না। এমনকি রান্নাঘরের প্রতিটা পদ থেকে প্রতিটা ইনগ্রেডিয়েন্ট আমরা টেস্ট করিয়েছি ল্যাবে। অজিতবাবুর রক্তে যে বিষ পাওয়া গেছে তার ট্রেস কোথাও পাওয়া যায়নি।

- বিষ খুঁজে হন্যে হলেন। অথচ ওই থালা শুঁকলেই ব্যাপারটা জলবৎ হয়ে যেত দারোগাবাবু।

- কে...কেন?

- ও থালায় বিরিয়ানির রেশের সঙ্গে পনীরের বদগন্ধ মিশে ছিল।

- মটন বিরিয়ানিতে পনীর?

- ইদানীং বিরিয়ানিতে থেকে মটনের টুকরো বেছে ফেলে দিয়ে তাতে বাবুলালের গোপনে সাপ্লাই করা পনীর মিশিয়ে খাওয়া শুরু করেছিলেন অজিতবাবু।

- মাই গুডনেস।

- আর অজিতবাবুর খাওয়াদাওয়ার গোপনীয়তা নিয়ে ক্রমশ সন্দিগ্ধ হয়ে পড়ছিলেন তাঁর তিন দাদা, বিশেষ করে বড়দা অমিতবাবু। বাবুলালকে তিনি মাঝেমাঝেই চাপ দিতেন অজিতবাবুর খাওয়াদাওয়ার খবর সবিশেষ জানতে চেয়ে। কিন্তু বাবুলালের বাঁ হাতে আয়ের নেশাকে ভালোই কাল্টিভেট করছিলেন অজিতবাবু, বাবুলালকে টলানো যায়নি। উপায়ন্তর না দেখে অজিতবাবুর খুনের দিন দুয়েক আগে এক ডিবে স্পেশ্যাল বিরিয়ানি মশলা বাবুলালকে দেন তিনি। সে ডিবে নাকি খোদ আরব দেশ থেকে আনানো। সে মশলায় তৈরি বিরিয়ানি খাওয়ার প্রথম রাতেই মারা যান সদ্য নিরামিষাশী বনে যাওয়া অজিত সেনগুপ্ত।

- অসম্ভব। রান্নাঘরের সব আইটেমের সঙ্গে ওই বিরিয়ানি মশলার ডিবের স্যাম্পলেও টেস্ট করানো হয়েছে। কোনও বিষ পাওয়া যায়নি।  আর তাছাড়া বাড়ির বাকি তিনজনও সে বিরিয়ানিই খেয়েছিল, তাঁরা তো বহাল তবিয়তে রয়েছেন।

- পুলিশ অফিসার এত সরল হলে মানায়? এমন ভাবে চললে আপনার প্রমোশন ডকে উঠবে।

- প্লীজ খোলসা করে বলুন।

- ইলিশের প্রতিশ্রুতি ভুলবেন না যেন স্যার।

- ভদ্রলোকের এক কথা। প্লীজ বটুবাবু।

- এ খুনি ছুরি গুলি চালানো গাম্বাট নয় ইন্সপেক্টর সাহেব। ও বিরিয়ানি মশলা এমনিতে সাদামাঠা, চিবিয়ে খেলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু পনীর আর মানুষের স্যালাইভা মিশে গেলেই ও মশলা খুনে বিষ। ও বাক্স থেকে সামান্য স্যাম্পেল আমি সরিয়েছিলাম। আমার বায়োকেমিস্ট বন্ধু বিধুশেখর নিজে পরীক্ষা করে আমার সন্দেহ কনফার্ম করেছে।

- ইনক্রেডিবল। তাহলে আর অপেক্ষা কেন? চট্ করে গিয়ে অমিতবাবুকে হেপাজতে নিয়ে নিই! ভদ্রলোকের আবার যা ইনফ্লুয়েন্স,  পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাবেন না তো?

- নিজের আদরের ভাইয়ের এমন অধঃপতনে একটা আঘাত পেয়েইছিলেন ভদ্রলোক, আর রাগের মাথায় এমন বীভৎস একটা কাণ্ড ঘটিয়ে এখন রীতিমত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন ভদ্রলোক, সে'টা স্পষ্ট। আমার বিশ্বাস সামান্য চাপ দিলেই উনি সব স্বীকার করে নেবেন। তবে হে ইন্সপেক্টর শিরোমণি,  প্রমোশন পেয়ে আমার ইলিশ সাপ্লাইটা ভুলে যাবেন না তো?

No comments: