Skip to main content

সাইকেলের বেল

সে’সব সন্ধ্যেগুলো।
বাবা ফেরার অপেক্ষায় মশগুল। বাবা সাইকেল চড়ে অফিস যেতেন। পরে অবশ্য মোটরসাইকেল এসেছিল, রাজদূত। কিন্তু হারকিউলিস সাইকেলের বেলের ক্লিংকিং ক্রিংই স্মৃতিতে বেশি স্পষ্ট । বাবা বাড়ির সামনের গলিতে ঢুকে বেল বাজাতেন আর টুং করে সন্ধ্যের রঙ পালটে যেত।

এ’বারে সন্ধেবেলা পড়ার বই নিয়ে বসা থেকে সাময়িক মুলতুবি।
এ’বারে ছাতের বেঁকে যাওয়া অ্যান্টেনা সোজা হয়ে যাবে, টিভির ছবি স্পষ্ট হবে।
এ’বারে শিঙাড়া নিমকি চপ।
এ’বারে মায়ের হাতে মাখা মুড়ি বা চিঁড়েভাজা।
এ’বারে কত গল্পের গলগলিয়ে বেরিয়ে আসা; স্কুলের, সিনেমার, বইয়ের।

এ’বারে ক্রিকেট।
ঘরের মধ্যেই। বসবার ঘরের দরজা বন্ধ করে সে’খানে পাপোষ হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে উইকেট হত । রাবার ডিউজ বল আর তিন নম্বরের কাঠের ব্যাট। পঁচিশ বলে ইনিংস, বল ব্যাটে লাগলেই একরান। ঘরের অন্য প্রান্তে রাখা সোফা পর্যন্ত বল পাঠাতে পারলে চার রান। শর্ট মিড অফ অঞ্চলে রাখা শোকেসের কাঁচে বল লাগলে আউট। ওয়ান বাউন্স ক্যাচ। আমি দু’বার আউট হলে তবে ইনিংস শেষ, বাবার অবশ্য দ্বিতীয় সুযোগ ছিল না। বাবা চা শেষ করলে শুরু হত ম্যাচ। রুদ্ধশ্বাস। টানটান। সাধারণত পর পর দু’টো ম্যাচ হত। কোনও কোনও দিন খেলা গড়াত তৃতীয় ম্যাচে। সে’দিন গুলোয় মায়ের মুখ গোমড়া হয় যেত। কারণ বাবার বাজারে বেরোতে দেরী, আমার পড়তে বসায় ফাঁকি।
হপ্তায় অন্তত দিন দুই ক্রিকেটের বদলে থাকতে ক্যারম। সরল নিয়মে আমি প্রত্যেক চালে দু’বার করে দান পেতাম যাতে লড়াই করতে পারি।

ওই।
আমি দু’বার আউট হলে তবে আউট।
পরপর দু’বার গুটি ফেলতে না পারলে তবে দান শেষ।
ওই।
বাবার বিরক্ত না হওয়া।
বাবার সাইকেল। ক্রিং ক্রিং।
রাজদূত মোটরবাইক।

বাবা রবিবার অফিসে গেলে বেজায় খুশি হতাম। ঝুলে পড়তাম বাবার সাইকেলে বা বাইকের পিছনে। বাবার অফিসে যাওয়ার পথে রাস্তার দু’পাশ দিয়ে ইউক্যালিপটাস, বাতাস তার নরম সুবাসে হামেশা ভারী হয়ে থাকত। বাবার অফিসের কম্পিউটারে ডস-বেস্‌ড রেসিং গেম। বাবার অফিসের একটা নীল টেলিফোনে জিরো ডায়াল করলে এক অচেনা কণ্ঠ বিড়বিড় করে অনেক কথা বলে যেত।
বাবা।
আমার বাবা। আমার দু’বার আউট আর দু’বার গুটি ফেলার সুযোগ দেওয়া বাবা। গায়ে ছায়াগন্ধ বয়ে বেড়ানো বাবা।
“ঠিক সামলে নেবে” মার্কা বাবা।

রোজ সন্ধেবেলা মনে হয় বাবার জন্য বসে আছি। অফিসে হোক, গাড়ির স্টিয়ারিঙের পিছনে হোক, ভিড়ে হোক, হুল্লোড়ে হোক, গোলমালে হোক। টের পাই বাড়ির সামনের গলিটার টুং শব্দে আলোময় হয়ে যাওয়া।  
আমায় একবারে আউট করা যাবে না। এক দানে গুটি ফেলতে না পারলে পরের দান আছে।
বাবা আছে। বাবা সামলে নেবে।
 এই বিস্বাদ সিলেবাস ছুঁয়ে বসে থাকা দেখনাই মাত্র, বাবা অফিস থেকে ফিরল বলে।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু