Thursday, December 4, 2025

মদনমোহন


চৌকির ওপর বসে বাবু মোহনদাস অসীম তৃপ্তিসহ একশো টাকার নোটের একটা ঢাউস বান্ডিল গুনছিলেন। স্যাঙাৎ মদন মেঝেয় বসে লুডোর বোর্ড পেতে লাল-হলুদে নিজের হয়ে চাল দিয়ে নীল-সবুজের নিজেকে পর্যুদস্ত করতে ব্যস্ত। রাত এখন পৌনে ন'টা। অজ গাঁ, এখানের রাত ন'টা প্রায় রাত দেড়টার সমান। তায় আবার ভরা-ডিসেম্বর, টিনের চাল ফাঁকি দিয়ে কনকনে হাওয়া মোহনদাসের গায়ের শাল ভেদ করে যেন বরফকুচি ছড়িয়ে দিচ্ছে। নেহাত সস্তা টাকায় বিস্তর গরম, তাই এই অচেনা গাঁয়ের দাপুটে শীতকে বিশেষ পাত্তা দিচ্ছিলেন না মোহনদাস। মদনের অবশ্য শীত, টাকা, চোরাইমাল এ'সবে কিছু এসে যায় না। সে লুডো-সাধক, দু'ছক্কা তিন কী'ভাবে সাজালে মুক্তিলাভ হবে, এ ধরণের চিন্তাতেই তাঁর রাতভোর হয়ে যাবে।

হুগলির অন্যতম সেরা ওয়্যাগন-ব্রেকার মোহনদাসের লেজুড় হয়ে ঘুরে সুখেই আছে বর্ধমানের মদন সাহা। এই ভবঘুরে জীবনের জন্যই যেন তার জন্ম। মোহনদাস চাইলে সে চলতি মালগাড়ি থেকে অবলীলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ওজনদার বস্তা কাঁধে। মোহনদাস চাইলে সে নির্দ্বিধায় পুলিশের লাঠি বা অন্য মস্তানদের লাথি পিঠ পেতে নিয়ে ফাঁকতালে নিজের কাজ হাসিল করে বেরিয়ে যায়। মোহনদাস চাইলে সে আলুপোস্ত কি মেটেচচ্চড়ি রেঁধে দুনিয়া গুলজার করে দেয়। মোহনদাসের ঠিকভুল নিয়ে মাথা ঘামানোর বান্দা মদন নয়, সে লুডো-বাউল; তাঁর আনন্দ দিনের শেষে দু'তিন দান লুডো খেলতে খেলতে কিশোরকুমারের হিন্দি গান গুনগুন করায়।

- হ্যাঁ রে মদনা, বিড়ি দে দেখি।
- এই যে...।
- এ'বারের দাঁওটা বুঝলি, ভালোই মেরেছি।
- কেয়া বাত।
- ভাবছি তোকে এ'বারে একটা নতুন শার্ট কিনে দেবো। যে'ভাবে আজ জানের ওপর খেলে তুই...।
- একটা ভালো প্রিন্ট দেখে দিও বুঝলে। ফুলফুল হলে বেশ হয়।
- মদনা। এই যে আমার হয়ে ভূতের মত খাটিস, লুটের মাল ভাগ বসাতে ইচ্ছে হয় না? শয়ে পাঁচ কি দশ তুই চাইলেই আমি কিন্তু..।
- আমি বেতন নিয়ে খাটা মানুষ গো দাদা। চুরির কয়লায় ভাগ বসালে লুডোর চাল যাবে ভেস্তে। তুমি আমায় শয়ে পাঁচ গছালে আমার রান্না আলুপোস্তের অমৃতস্বাদ আর থাকবে ভেবেছ?
- মদনা রে। তুই বড়ই হারামি।
- তোমারই আশীর্বাদ গুরু।
- বড় শীতে পেয়েছে রে মদনা। আগুনটাগুন জ্বাল। আর টাকার থলেটা সরা মাইরি। যত আপদ।
- এখুনি..। দু'মিনিটে..।
- মদনা রে, একদান লুডো খেলবি আমায় নিয়ে?
- দাদা গো, এ জিনিস তোমার সইবে না।
- আমায় কুত্তা বলছিস?
- আগুনের ব্যবস্থা করি আগে। তুমি ততক্ষণ আর একটা বিড়ি ধরাও।

সংগ্রামী সাইকেল


শখের সাইকেলকে ক্যালরি ঝরানো যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করাটা যে কী নিরেট নিষ্প্রাণ বেরসিক একটা ব্যাপার।

মনে রাখবেন:

- মনখারাপের ক্ষেত্রে সাইকেলের প্যাডেল ঠেলার কচরমচরটা চমৎকার টনিকের কাজ দেয়।

- ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে সাইকেলে নিয়ে বেরোনো মানে নিজের মনকে কষে মালিশ করা।

- আর সাইকেল চালানোর সময় গুনগুনিয়ে রফি ধরলে সতেরোটা কবিতা লেখার সমান পুণ্যলাভ হয়।

এর বাইরে ও ওপরে রয়েছে সংগ্রামী সাইকেল। মনখারাপ ম্যানেজে দেওয়ার শৌখিন সাইকেলের সঙ্গে তার তুলনা অদরকারি। তাদের শ্বাসপ্রশ্বাস আছে, তারা জাতে কমরেড। গানে বৃষ্টিতে তাদের মুক্তি নেই, তাদের উত্তরণ দৈনন্দিন যুদ্ধে ও ঘামে।

দেখা হ্যায় পেহলি বার


এ ছবিটা ঢাকুরিয়ায় তোলা। অফিস-ঘেঁষা চায়ের দোকানে। দোকানি দাদাটির বড় গুণ ছিল যে তার মধ্যে ছিঁটেফোঁটাও তাড়াহুড়ো ছিলো না। ডিমটা ফাটাতেন ধীরেসুস্থে। পাউরুটি ফালি করতেন মিহিমেজাজে। অফিসটাইমের দৌড়ঝাঁপ অথবা খদ্দেরদের ব্যস্ততা তাকে স্পর্শ করতে পারতো না।

তেল সঠিক লেভেলে গরম না হলে চাটুতে ডিম পড়তো না। স্টোভের আঁচ গনগনে রাখতেন না ডিম ভাজার সময়, কড়া তাপে ডিমের সেনসিটিভিটি ম্যানেজ দেওয়া যায় না। পাউরুটির গায়ের ডিম নির্ভুল লালে পৌঁছনো পর্যন্ত তিনিও চাটুর দিকে দেখছেন আর্টিস্টের মেজাজে, আমিও চাটুর দিকে চেয়ে আছি ভক্তের চোখ নিয়ে। তারপর সে ডিমপাউরুটি তুলে নেওয়া হবে পরিষ্কার প্লেটে, ছড়িয়ে দেওয়া হবে সামান্য মশলা ও নুন। সামান্যই; সে'টাই হলো ব্যালেন্স।

সকাল-সকাল অমন ভালো ডিমপাউরুটি পাতে পেলে যাবতীয় দায় বুকপকেটে নিয়েও অনায়াসে বিশ্বজয় করা যায়।

যা কিছু আমার


এই যে আমার অফিস টেবিল দেখছেন..এই যে বিস্তীর্ণ প্রান্তর..এইখানে আমি চরে খাই।

ওই আমার পোষা কম্পিউটার, আমি বাঁ চোখ নাচালে সে মিউ দেয় আর ডান চোখ নাচালে হালুম। ওই গ্যালো খটরখটরিয়া কিবোর্ড, ওই হলো মিচকে মাউস। এই হলো গিয়ে বাহারে কলমদানি যার মধ্যে ওই দেখুন কুড়ি টাকা পিস মারাত্মক এফিশিয়েন্ট ডটপেন; চারখানা। চারে মিলে ওরা আমার পার্সোনাল গেরিলা বাহিনী। আর এই পাশে দেখুন, একটা পেটমোটা ডায়েরি, তা'তে হাবিজাবি কাজের।নোট লেখা। আর সে ডায়েরির ওপর উপুড় করে রাখা ওই যে পকেট-সাইজের স্পাইরাল নোটবই যা'তে টোকা আছে মনের খবর, ধোপার হিসেব এবং মাসকাবারির প্ল্যান।

এই শশব্যস্ত টাইমস স্কোয়্যার কোণার এক কণায় রয়েছে একটা নিঝুম দুপুরের নিরিবিলি ঠাকুরদালানের ছড়িয়ে বসা তাসের আড্ডা৷ বসের দাবী, সহকর্মীর খেজুর, ফাইলের ভিড়, এক্সেলের ফর্মুলার দাপটে আমার সে কণাটা হয়তো সহজে কারুর চোখে পড়ে না; কিন্তু সে'টা আছে জানেন৷ আছে বলেই ওই টেবিলেই মুক্তি, ওই টেবিলেই হঠাৎ গা এলিয়ে দেওয়ার দু'সেকেন্ড। ওই কুরুক্ষেত্র টেবিলেই হিমালয়, ওই টেবিলেই।

গান ও মানুষ


"গান ও মানুষ
রাস্তা ও ফুল
সন্ধে ও ফেরা"

এলোপাথাড়ি কয়েকটা শব্দ বলে একটা বড়সড় দীর্ঘশ্বাস ফেললে বড়দা।

"শরীর খারাপ লাগছে রে দাদা? একটা ট্যাক্সি নিয়ে নেবো"?

"নেভার ফেল্ট বেটার। আমি চাইলে এখন সহস্র মাইল হেঁটে যেতে পারি। তা'ছাড়া সন্ধের এই নরম আলো-বাতাস বেশ গ্লুকোজের কাজ করছে"।

এ কথার পিঠে কথা চলে না।
বড়দাটা বরাবরই এ'রকম।
সবাই বলে খ্যাপা, আমি বলি খ্যাপাটে।
সবাই ওর বকবক থেকে পালিয়ে বাঁচে, আমি ওর কাছে পালিয়ে আসি। বরাবরই।

ও পারলেই আমায় লজেন্স কিনে দেয়, যেমনটা দিত তিরিশ বছর আগে নিজের বইপত্র কেনার টাকা থেকে। আজও দিয়েছে। ও ঠিক বুঝতে পারে না আমি দিব্যি একটা চাকরি সংসার ঠেলা বুড়োটে লোক। ও জানে আমি ওর ছোট। তাই ওর পাশে আমি এত নিশ্চিন্ত।

"ছোট, পরের ম্যাচে তোকে তিন নম্বরে নামাবো। নন্তুদের থোঁতামুখ ভোঁতা করে দিস"।
উত্তর না দিয়ে বড়দার ডান হাতটা শক্ত করে ধরলাম। রাস্তা পেরোতে হবে।
"রাস্তা পেরোনোর ভয় তোর এখনও গেল না রে ছোট"।
"তুই থাকতে আমার বাড়তি সাহসের দরকারটা কী"?
"শোন, নন্তুর স্লোয়ারটা কিন্তু বড্ড ডেঞ্জারাস"।
"কিছু খাবি দাদা"?
"খিদে পেয়েছে বাবু? চল মিলনদার চপ খাওয়াই আজ তোকে। চল তারপর তোকে বাঁটুল কিনে দিই। চল তারপর মেঘপিসের বাড়ি গিয়ে স্পোর্টস্টার নিয়ে আসি। চল.."।

মেজদাকে নিয়ে একটা কেএফসিতে ঢুকে পড়লাম।
"মিলনদার মত মুর্গির চপ আর কেউ বানাতে পারে কি ছোট? বল....বুকে হাত রেখে বল..সত্যিই পারে কি"?

বড়দাকে খাইয়ে দেওয়ার সময় মনে হয়ে মনের ভিতরটা কেউ গান আর সাবান দিয়ে ধুইয়ে দিচ্ছে। বড়দার মত আর কেউ ভালোবাসতে পারে কি? বুক হাত রেখে বলতে পারি, কেউ না। আমায় ওর মত ভালোবাসতে কেউ পারে না।

কাঁচালঙ্কায় কেল্লাফতে


কাঁচালঙ্কা এমন একটা ভালো ব্যাপার যে বুঝেসুঝে ছড়িয়ে দিতে পারলে হাইক্লাস কেল্লাফতে হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এই যেমন ইন্সট্যান্ট নুডলস; তা সে ব্যাপারটা আজকাল মোটের ওপর কমই খাই। কিন্তু যখন খাই, তখন কাঁচালঙ্কার দরাজ ব্যবহারটা খুবই প্রয়োজনীয় বোধ হয়।

আজকাল আবার নতুন স্ট্র্যাটেজি ধরেছি। এক প্যাকেট ম্যাগি খাই ডবল মশলা (টেস্টমেকার) দিয়ে। অতএব পরের প্যাকেটটা খাই মশলা ছাড়া (চাউমিন স্টাইলে)। তা ডবল টেস্টমেকার দিয়ে সিঙ্গল ম্যাগির ক্ষেত্রে কয়েকটা ব্যাপার আমায় মাথায় রাখতে হয়ঃ

প্রথমত, সেদ্ধ ব্যাপারটা বেশির দিকে যাওয়ার থেকে কমের দিকে থাকা ভালো। আর জল অতি সামান্য, সুতোগুলো অতি সামান্য নরম করে নেওয়ার জন্য যতটুকু প্রয়োজন তার চেয়েও সামান্য কম।

দ্বিতীয়ত, মাখনের পরিমিত ব্যবহার। তাল তাল নয়, প্লীজ। পরিমিত মানে কতটা? বলাই বাহুল্য আমার হিসেব আপনার হিসেবের সঙ্গে মিলবে না।

তৃতীয়ত, ওই। কড়াই থেকে তুলে নেওয়ার আগে ম্যাগিতে ফেলে দেওয়া খান চারেক পেট চিরে দেওয়া কাঁচালঙ্কা। কুচিকুচির চেয়ে দেখেছি ম্যাগির মধ্যে এই পেট চেরা গোটা লঙ্কারা বেশি এফেক্টিভ।

এই ব্যাপারগুলো দোকানের কেনা ম্যাগিতে কিছুতেই পাওয়া যায় না। চীজটীজ ক্যাপসিকাম-ট্যাপসিকাম হাজাররকম জিনিস গুঁজে দেওয়াই যায়, কিন্তু ইনস্ট্যান্ট নুডসল ব্যাপারটাই হচ্ছে সহজ অঙ্কে এগিয়ে যাওয়ার খেল। কোনো রকমের বাড়াবাড়ি সে'খানে চলবেনা। অতএব পাহাড়ে গেলেও, ম্যাগির দোকান নয়; ম্যাগির প্যাকেট হাতে স্টোভ খুঁজে হন্যে হতে হয়।

লোভ


- আসি?
- বেরোবে দাদা?
- হ্যাঁ, এ'বারে বেরোলেই হয় আর কী।
- এসো তবে..।
- অবশ্য তাড়াহুড়ো তেমন ছিলো না..।
- নাহ্। রাত হচ্ছে। অদ্দূর যাবে..।
- তাও ঠিক। আসি, বুঝলি?
- হুম।
- কফিটা একটু মন দিয়ে বানাতে পারতিস।
- আসলে হয়েছে কী..। এ'বারে যে কফিটা এনেছিলাম..।
- কফি ঠিকই দিয়েছিলিস। দুধ-চিনির ব্যালেন্সটাও ঠিকই ছিল। মন দিয়ে করার ব্যাপারটাতেই ফস্কে গেল ব্যাপারটা। পরের বার কিন্তু কোনো এক্সকিউজ শুনছি না।
- পরেরবার কেন? আর দশ মিনিট বোসো। আমি চট করে এক কাপ..।
- নাহ্। মন বেরিয়ে বাসস্টপ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। শরীরটা এ'বার ঠেলেঠুলে এগিয়ে না নিলেই নয়।
- বলছিলাম কী, রাত যখন হয়েই গেলো। আজকের রাতটা থেকেই যাও না হয়। কফিতে মন গেল না, ভাতেভাতটা মন দিয়েই হবে। তারপর দু'জনে মিলে রাতভর তাস পেটানো যাবে।
- আর তো বসার উপায় নেই রে ভাই। শোন, সাবধানে থাকিস। ভালো গান শুনিস। ভালো ভালো গল্পের বই পড়িস। কেমন?
- ধুস, এখন মনে হচ্ছে..।
- আসি ব্রাদার..।
- না। শোনো। তোমায় বসতেই হবে। হাইক্লাস বিয়েবাড়ি মার্কা কফি না খাইয়ে তোমায় ছাড়ার প্রশ্নই ওঠে না..।
- এই যে কফির জন্য পিছু ডাকলি, তা'তেই হবে।
- ধুরছাই।
- আমি কি কফির জন্য এসেছিলাম ভেবেছিলিস? ধুস। গপ্প আড্ডা? এক সময় সে'সব তো কম হয়নি। পিছুডাকের লোভেই এসেছিলাম। আদায় করে নিয়েছি।
- আরে..।
- আসি। কেমন? আলভিদা। অন্য কোনোদিন, অন্য কোনো সীনে..। তদ্দিনের জন্য..বিদায় কমরেড।
- এসো।