Skip to main content

বোমা ও বেহেস্ত



আদেকুম্বির মনে হচ্ছিল আহ্লাদে বুঝি সে পাগল হয়ে যাবে। ভোরের আকাশের মত মেঝে, ঘাস সবুজ ছাত। কতরকমের কত রঙের প্রজাপতি যে উড়ে বেড়াচ্ছে চারিদিকে তার ইয়ত্তা নেই। হাওয়ায় গরম ভাত আর ভ্যানিলা আইসক্রিম মেশানো মন পাগল করা গন্ধ। আদেকুম্বি আহ্লাদে লাফিয়ে নিল। দশ বছরের জীবনে এমন জায়গা সে কোনোদিন দেখেনি।

ঘরের মধ্যে বয়ে যাচ্ছে নদী; মজার ব্যাপার হল কুলুকুলু শব্দে না - নদী চলেছে টুংটাং শব্দে। সবুজ রঙের কাঠবেরালি, হলুদ ময়ূর, মিষ্টি পাউরুটির গাছ; কত আজব সুন্দর জিনিষ যে তার নজরে পড়ছে একের পর এক। আদেকুম্বি দেখে আর হাততালি দিয়ে ওঠে। আদেকুম্বি যেদিকেই ছুটতে যায় সেদিকেই রয়েছে মজার কিছু। জ্যান্ত সোনার উট তার চোখে বসানো হীরে, গোলাপি লোমের ভল্লুক- কত কী।

ছুটতে ছুটতে আদেকুম্বি হঠাৎ একটা শ্যাওলা মাখানো ঘরে ঢুকে পড়লে। এই ঘরটা বিচ্ছিরি। মেঝেয় শ্যাওলা, ছাতে শ্যাওলা, হাওয়ায় শ্যাওলা উড়ছে- ভ্যাপসা গন্ধ। আদেকুম্বি ছুট্টে সে ঘর থেকে পালাতে যাবে এমন সময় তার কানে ভেসে এলো হাউহাউ কান্নার শব্দ - একজন, দু'জন নয়- বহু লোকে একসাথে কাঁদছে। কান্নার শব্দ ধাওয়া করে আদেকুম্বির দৃষ্টি ঘরের কোণের দিকে গেল আর সে অবাক হয়ে দেখলে একদল মানুষ সেখানে কান ধরে হাঁটু গেড়ে বসে রয়েছে। মানুষগুলো প্রত্যেকে আদেকুম্বির দিকে তাকিয়ে হাপুস নয়নে কেঁদে যাচ্ছে।

বিব্রত হয়ে আদেকুম্বি জিজ্ঞেস করলে; "তোমরা কে গো?"।
প্রত্যেকে চিৎকার করে নিজের নাম বলে গেলে। শয়ে শয়ে নাম; আদেকুম্বি এত্তটুকু মেয়ে, সে কি পারে সব নাম মনে রাখতে? কয়েকটা নাম শুধু মনে রয়ে গেল; দ্য ভিঞ্চি, রবীন্দ্রনাথ, গালিব, চ্যাপলিন, ম্যান্ডেলা; আরও খটমট কত নাম।

-"তোমরা এমন ভাবে কাঁদছ কেন?", চিৎকার করে জানতে চাইলে আদেকুম্বি।



-"তোমার জন্য", সক্কলে কোরাসে জবাব দিলে।
-"এ মা, আমার জন্য কাঁদছ কেন? আর এমন ভাবে কান ধরে হাঁটু গেড়েই বা বসে কেন তোমরা?"
-"আমার নিজেদের শাস্তি দিয়েছি মা। অবশ্য কোন শাস্তিই যথেষ্ট নয়। তবুও দিলাম। তোমার এই কষ্টের জন্য তো মামনি আমরাই দায়ী", এবারও কোরাসে উত্তর।
-"আমার কষ্ট কিসের? আমি তো বেহেস্তে এসেছি গো?", আদেকুম্বি এ কথা বলতেই কান্নার রোল আরও ঘনীভূত হল।
-"এ বেহেস্ত নয় বেটি। এ তোর মনের ভুল। অবশ্য অন্যায় আমাদেরই। আমরাই তোর জন্য সঠিক পৃথিবী রেখে যেতে পারিনি মা আদেকুম্বি। তাই তো দশ বছর বয়েসে তোকে সুইসাইড বম্ব হয়ে মসজিদে ঢুকতে হয় মানুষ খুন করতে। এ ভুল তোর নয় মা। আমরাই তোর অপরাধী। আমরাই পৃথিবী থেকে বিষ শুষে নিয়ে আসতে পারিনি। আমাদের কবিতা, গান, আবিষ্কার, সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান সমস্ত মিথ্যে মা। যে মানব সমাজে তোর দাম নেই, সে মানব ইতিহাসের দাম নেই মা। সেই সমাজ, সেই ইতিহাসের মলিকিউল যে আমরাই। আমাদের ক্ষমা কর"।
-" বেহেস্ত নয় কেন বলছ? ওই যে দেখলাম টুংটাং সুর তোলা নদী, সবুজ কাঠবেরালি, পাউরুটির গাছ; আরও কত কী! ঠিক যেমনটা বলেছিল সেই কাকুটা যে আমার বুকে পেটে বোমা বেঁধে দিয়েছিল। এটা বেহেস্তই তো"।
-"ওসব তুই যা দেখেছিস মা সেগুলো তোর মাথায় গুঁজে দেওয়া ভাঁওতা। ওটা বেহেস্ত নয়। বাস্তব নয়।এই শ্যাওলা ঘরের মধ্যেই তোকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে মা। তোর মুক্তি নেই। তোর দুঃখের ভাগ নিতে আমরা এ ঘরে এসেছি", ঠাণ্ডা কান্নায় ফ্যাসফ্যাসে গলায় কোরাস বললে।
শিউরে উঠে আদেকুম্বি দেখলে সত্যিই এই শ্যাওলা মাখানো বদ্ধ ঘরের দরজাটা আর দেখা যাচ্ছে না।

-"তোমরা খারাপ লোক, তোমরা আমায় বেহেস্তে ফেরত যেতে দাও", আদিকুম্বি এবার কেঁদে উঠলে।
কান্নার কোরাস আরও জোরালো হল।
দাড়িওলা লোকটা এবার উঠে এসে আদেকুম্বিকে জড়িয়ে ধরলে।

-"তুমি কে? আমায় বেহেস্তে যেতে দাও...", আদেকুম্বির মনে হল সে অজ্ঞান হয়ে আসছে।

-"আমার নাম রবীন্দ্রনাথ রে মা", লোকটা আদিকুম্বির পেট থেকে বেরিয়ে আসা নাড়িভুঁড়ি আদিকুম্বির পেটে ঢোকাবার চেষ্টা করতে করতে বললে, "সমস্ত মিথ্যে আদিকুম্বি। তোর বেহেস্ত মিথ্যে। যারা মানুষ খুন করতে দশ বছরের শিশুদের ব্যবহার করে তারা মিথ্যে। এমনকি আমরাও মিথ্যে- আমাদের সৃষ্টি সমস্ত মিথ্যে। শিশুরা যেখানে বলি যায় মা, সে ইতিহাস তো পুরোটাই মিথ্যে। আমরা, এখানের এই বুড়োগুলোও সেই ইতিহাসেরই অংশ রে মা। আমাদের কাউকে ক্ষমা করিস না আদেকুম্বি। ক্ষমা করিস না। ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমাদের অভিশাপ দে মা। অভিশাপ দে আমাদের সভ্যতা কে, ইতিহাস কে। আমাকে। কাউকে ছাড়িস না রে মা। কাউকে ছাড়িস না। আমরা সবাই মিলে সত্তর হাজার বছর ধরে তোকে খুন করার ছক কষেছি। ক্ষমা করিস না আমাদের। ক্ষমা করিস না"।

(খবর/ স্ক্রিনশট সূত্র - বিবিসি)

Comments

তন্ময়দা তোমার এই ভাবনাগুলো পড়তে গিয়ে বারবার মুগ্ধ হই |

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু