Skip to main content

স্নোডেনবাবুর পার্মানেন্ট রেকর্ড


অনলাইন দুনিয়াটা যে অফলাইনের মতই গুরুত্বপূর্ণ, কথাটা সম্পূর্ণ ভুল; অনলাইন দুনিয়ার গুরুত্ব অনেক বেশি। নিজের ফাঁকা বাড়িতে অচেনা কাউকে ঘণ্টাখানেকের জন্য একা ছেড়ে দেওয়ার চেয়েও খতরনাক হচ্ছে সেই অচেনা ব্যক্তির হাতে মিনিট পাঁচেকের জন্য নিজের সমস্ত অনলাইন অ্যাকাউন্ট তুলে দেওয়া। 'পার্মানেন্ট রেকর্ড'য়ে এডওয়ার্ড স্নোডেন এই জলবৎ তরলং উদাহরণটা ব্যবহার করেছেন।

আমি নিজে আর যাই হোক'টেকি' নই। পলিটিকাল ফ্রীডম বা প্রাইভেসি নিয়েও যে দু'চারটে জরুরী কথা বলতে পারব তা নয়। মার্কিন রাজনীতি সম্বন্ধে আমার অজ্ঞানতা রীতিমত গভীর। কাজেই স্নোডেনের আত্মজীবনী পুরোপুরি আত্মস্থ করতে পারা আমার পক্ষে তেমন সহজ কাজ নয়। তবে যেহেতু ইন্টারনেটের মধ্যে জীবনের অনেকটাই সেঁধিয়ে গেছে, তাই বই পড়ে শিউরে উঠতে অসুবিধে হয়না। এর আগে স্নোডেনের কাজকর্ম সম্বন্ধে অল্পবিস্তর উইকি-লেভেলে পড়াশোনা ছিল বটে। কিন্তু বই পড়ে যেটা অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে সেটা হল ওঁর পয়েন্ট অফ ভিউ, লজিক আর ওঁর আকস্মিকবোমা ফাটানো পটভূমিটা। আমার ধারনা এই বই যদি হারারিরটুয়েন্টি লেসন্স ফর দ্য টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরিপাশাপাশি পড়া হয় তবেইমপ্যাক্টটা আরো জমাটি হবে। স্নোডেনের ক্রুসেড মূলত রাইট টু প্রাইভেসির পক্ষে এবং তাঁর বেশির ভাগ বক্তব্যই বেশ মজবুত সব যুক্তির ওপর দাঁড়িয়ে। ঠিক বিষয় নিয়ে অবশ্যই হারারি সাহেব ততটা গভীরে গিয়ে আলোচনা করেননি বটে কিন্তু যেটুকু করেছেন সেটা সম্ভবত আরো বেশি ব্যালেন্সড। যা হোক, হারারির সে বই সম্বন্ধে পোস্ট নয়। স্নোডেনের আত্মজীবনীপার্মানেন্ট রেকর্ডপড়ে যে দুএকটা কথা মনে হল, তা লিখে রাখি বরং।

১। স্নোডেন প্রায় আমারই বয়সী। তাঁর প্রথম কম্পিউটার উচ্ছ্বাস আর প্রথম ইন্টারনেটে ভেবড়ে যাওয়ার অংশটুকু যে কী চমৎকার। একজন আমেরিকান আর একজন ভারতীয়র জন্য নব্বুই দশকের টেকনোলজিকে ঠিক সমান্তরাল বলা চলে না যদিও, কিন্তু স্নোডেনের সেই উচ্ছ্বাসের গল্প শুনতে আমার দিব্যি লেগেছে।

২। নব্বুই দশকের ইন্টারনেট আর /১১র পরের ইন্টারনেট জগতের তফাতটা চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছেন স্নোডেন। এই অ্যানালিসিসটুকুই সম্ভবত এই বইয়ের সবচেয়ে মূল্যবান অংশ। আদি-ইন্টারনেটে ভুলভ্রান্তি কম ছিল না, তবে তার সঙ্গে ছিল সেসব ভুলভ্রান্তি বাদ দিয়ে নতুন ভাবে শুরু করার অজস্র সুযোগ; অর্থাৎ অনলাইন রেকর্ড তখনও সেভাবেপার্মানেন্টহয়ে ওঠেনি। স্নোডেন চমৎকার ভাবে বুঝিয়েছেন সেই আদিম ইন্টারনেট কেমন ভাবে তাঁকে সমৃদ্ধ করেছিল। একটা খুব ইন্টারেস্টিং কথা প্রসঙ্গে বলেছেন এড স্নোডেন; বর্তমান যুগের ইন্টারনেট একটাএক্সট্রিম জাস্টিসয়ের কনসেপ্ট তৈরি করেছে। ঠিক ভুল বিচার করার আমি অন্তত কেউ নই তবে স্নোডেন জোরালো তর্ক জুড়েছেন সেইএক্সট্রিম জাস্টিসেরবিরুদ্ধে।

৩। বলাই বাহুল্য স্নোডেনের লেখার অনেকটা জুড়ে রয়েছেহুইসল ব্লোয়িংপ্রসঙ্গ। পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন শক্তিশালী শাসকদল জনমত তৈরি করতে অনেক গোপন সামরিক তথ্যও সুচারুভাবে মিডিয়াতেলীককরে থাকেন অথচ তাঁরাই আবার খড়্গহস্ত হয়ে ওঠেনহুইসল ব্লোয়িংয়ের বিপক্ষে। এই দুইয়ের টানাপোড়েন নিয়ে স্নোডেনের আলোচনাটা যথেষ্ট যুক্তি/তথ্য নির্ভর।

৪। আমাদের অনলাইন জীবনের ওপর সরকারি নজরদারী যে কী আশঙ্কাজনক পর্যায় এসে পৌঁছেছে তাঁর বিবরণ আজকাল মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন প্রবন্ধে বা ব্লগপোস্টে পাওয়া যায়। কিন্তু /১১র পর আঙ্কল স্যামেরসার্ভেলান্সযে কী বিষম আকার ধারণ করেছে তা জানার জন্য বই বেশ চমৎকার (এবং খানিকটা ভয়াবহ) আর গড়পড়তা পাঠককে সেই সার্ভেলান্সেরপ্রসেসটা বেশ মনোগ্রাহী ভাবে বলেছেন স্নোডেন। ধৈর্য ধরে বুঝিয়েছেনমেটাডেটা মত কনসেপ্টগুলো। আমেরিকান রাজিনীতির রেফারেন্স বেশ কিছু ক্ষেত্রে ট্যানজেন্ট ঠুকে বেরিয়ে গেলেও ব্যাপারটার গুরুত্ব ঠাহর করতে অসুবিধে হয়না। আমি নিজে নিজেকে কতটুকু জানি; আমায় তার চেয়ে ঢের বেশি জানে সার্ভার।

৫। আমার ব্যক্তিগত ভাবে সবচেয়ে ভালো লেগেছে স্নোডেনের /১১ পরবর্তীআমেরিকান রিভেঞ্জয়ের গল্প এবং সেই সম্পর্কে তাঁর অস্থিরতা। কতটুকুকোল্যাটেরাল ড্যামেজকেএমনটা তো হয়েই থাকেমার্কা নির্লিপ্তিতে মুড়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া যায়? প্রতি একশোজন সহনাগরিকের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য হানা পাল্টা আঘাতে কতজন শিশুর মৃতদেহকেকোল্যাটেরাল ড্যামেজহিসেবে মেনে নেওয়া উচিৎ? স্নোডেন ভাবিয়েছেন। তিনি স্বীকার করেছেন যে দেশের অন্ধকার সময়ে চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠাটা স্বাভাবিক, কিন্তু তাঁর খটকা লেগেছে বেহিসেবি পাল্টা আক্রমণের নেশায়। এই বেহিসেবই তাঁকে ভাবিয়েছে, দেশের মঙ্গল ঠিক কোথায়; প্রশ্ন তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। আর শেষমেষ তাঁর বাঁধন ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়া; তাঁর হুইসল ব্লোয়িং বোমা। পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক চলতেই পারে। কিন্তু যে বয়সে তাঁর বিয়েথা ইএমআই ভ্যাকেশন ইত্যাদির প্ল্যান করার কথা, সে বয়সে তিনি ঘটিয়ে বসলেন এই খতরনাক ব্যাপারটা; ফাঁস করলেন মার্কিন সরকারেরমাস সার্ভেলান্সবিষয়কক্লাসিফাইডতথ্য। সে গল্পটা যেমন রোমাঞ্চকর তেমনই মনখারাপের। তবে সেই আইডিয়ালিজম, রোমাঞ্চ আর মনখারাপটুকুই স্নোডেন এবং তাঁরকালাপানি শেষ কথা নয়। এই বইতে সযত্নে স্থান পেয়েছে তাঁর জীবনের সম্পর্কগুলোর কথা; দিব্যি সরল এবং সাবলীল ভাষায়।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু