Skip to main content

গহর ও রাজলক্ষ্মী

“ইতি তোমার মা” প্রথম পড়েছিলাম ক্লাস এইটে। শ্রীকান্ত অনেক পরে, সম্ভবত মাধ্যমিকের দেওয়ার পর। এই দুটো লেখার মধ্যে আদৌ কোনও যোগাযোগ নেই, কিন্তু কেন উল্লেখ করলাম সে’টা একটু খুলে বলি। সঞ্জীবের ক্ষেত্রে আমার যুক্তিনির্ভর (নিজের বোধ বুদ্ধিতে যতটা কুলোয় আর কী) সমীহ আর “আমার সঞ্জীব” মার্কা অঙ্কহীন ভালোবাসা; দুটোই যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে। সেই ভালোবাসার শুরু ওই “রাবণ বধ” আর “ইতি তোমার মা”কে নিয়েই। ছেলেবেলায় ‘ইতি তোমার মা’য়ের শেষ পাতায় দেওয়া মায়ের চিঠিটা যে কতবার পড়েছি আর কতবার যে ভেসে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। চিঠিতে কী অপরিসীম কষ্ট মিশে রয়েছে অথচ তবু সে লেখা কী নির্মল আর কী ভালোবাসার; দুঃখের ধবধবে সাদা বিছানায় স্নেহের রোদ্দুর মিশে যাওয়ার যে কী মায়াবী টান, কী অপরূপ সৌন্দর্য। ওই আড়াইশো মত শব্দে লেখা মায়ের শেষ চিঠি; “স্নেহের বুড়ো, আর কদিন পরেই আমি চলে যাব” বলে শুরু আর “বিদায়, অনেক ভালোবাসা। জল নয়, আগুন। ইতি তোমার মা”য়ে এসে শেষ। বয়সের মরচে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক সময় মনে হয়েছে চিঠিতে কিছু উপদেশ গুঁজে দেওয়া আছে বোধ হয়। কিন্তু এ চিঠি মন দিয়ে পড়লেই সে জ্যাঠামির ভাঁওতা কেটে যায়; ভালোবাসা আর মায়ের সুবাস ছাড়া এ চিঠিতে কিছুই নেই, এ চিঠি মা “নেই বলেই আর বেশি করে থাকবে”র চিঠি। গোটা গল্পটার ব্যাপারে হলফ করে বলতে পারি না, তবে এ চিঠি থেকে ইহ জন্মে আর আমার বেরোনো হবে না। 

সদ্য শ্রীকান্ত উপন্যাসটা ফের পড়লাম, এর আগে এ বই পড়েছি অনেক আগে। তবে মাঝেমধ্যে তাক থেকে শরৎ রচনাবলী নামিয়ে “শ্রীকান্ত” আর “পথের দাবী” র‍্যান্ডমলি কিছুটা পড়তে দিব্যি লাগে।  ‘ইতি তোমার মা’য়ের মতই এ উপন্যাসেও একটা শেষ চিঠি রয়েছে; রয়েছে গল্পের শেষের দিকেই। 
গহরের শেষ চিঠি। শরৎবাবু যে বিশেষ ফলাও করে সে গোটা চিঠিটা পাঠকের জন্য যে সাজিয়ে দিয়েছেন তাও নয়, স্রেফ সে শেষ চিঠি থেকে দু’লাইন তুলে দিয়েছেন মাত্র। নেহাতই যাকে বলে “পাসিং রেফারেন্স”, অনেকটা গোটা বইতে গহরের উপস্থিতির মতই। কিন্তু যত দিন গেছে, সেই দু’লাইনের ‘ব্রেভিটি’ মনের মধ্যে প্রকাণ্ড হয়ে উঠেছে, আমি জড়িয়ে ধরেছি গহর চরিত্রটি। এই চিঠিতে আমি বার বার ফেরত গেছি; সেই টানেই এ উপন্যাস ফের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়া।

“ ভাই শ্রীকান্ত, 

আমি বোধ হয় আর বাঁচব না। তোমার সঙ্গে দেখা হবে কিনা জানি না। যদি না হয় (এই) বাক্সটি রেখে গেলাম, নিও। টাকাগুলি তোমার হাতে দিলাম। কমললতার যদি কাজে লাগে, দিও। না নিলে; যা ইচ্ছে হয় তাই কোরো। আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুন। - গহর”। 

যদি আপনি শ্রীকান্ত না পড়ে থাকেন, তাহলে অভয় দিয়ে বলি উপরের কোট করা দুলাইনে স্পয়লার নেই আদৌ। কিন্তু রুখাশুখা ক’লাইনে যে কী পরিমাণ স্নেহ আর কী বেপরোয়া ভাবে উজাড় হওয়া রয়েছে তা অনুভব করতে হলে গোটা উপন্যাস পড়া ছাড়া গতি নেই। ওই “ভাই শ্রীকান্ত”র মধ্যে যে বিশ্বাস, “দেখা হবে কিনা জানি না”র মধ্যে যে বিচ্ছেদের ব্যথা, ‘নিও’র মধ্যে যে সমর্পণ; তা বিশদে বোঝাবার ক্ষমতা থাকলে বর্তে যেতাম। 
আর রয়েছে “না নিলে যা ইচ্ছে হয় তাই কোরো। আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুন”। প্রবল ভাবে ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট এই লাইনে রয়েছে গহরের প্রেম, অভিমান আর বন্ধুত্ব। ওই, আমি আদেখলার মত সস্তা বিশেষণই ব্যবহার করে যেতে পারি; কিন্তু আদত গহরকে অনুভব করতে হলে শ্রীকান্তবাবুর জার্নাল ছাড়া উপায় নেই। জীবনে কিছু বন্ধুর মত বন্ধু জুটেছে বটে; যেদিন সরেটরে পড়ার সময় হবে, সে শালাদের মনে করে আমি গহরের শেষ চিঠিটুকুই বারবার পড়তে চাইব। আমি নিশ্চিত।

শ্রীকান্ত উপন্যাসের মূল রস বোধ হয় শ্রীকান্তর ডায়েরিতে বিভিন্ন চরিত্রের আসা যাওয়ায়, তাঁদের জটিল বুনোটে বাঁধার চেষ্টাও করেননি শরৎবাবু। কিন্তু ঘুরেফিরে সেই “ব্রেভিটি”তেই তাঁরা উজ্জ্বল। অভয়ার জীবনের সুবিশাল ট্র্যাজেডিতে তাই রোহিণীবাবুর নিষ্ঠা ঢেকে যায় না, কমললতার নিষ্পাপ ভালোবাসার দিগন্তজোড়া গল্পের সামনে  তাই আখড়ার বড়গোঁসাইয়ের নিঃশব্দ উপস্থিতি মূল্যহীন হয়ে পড়ে না, আধ-পাতার উপস্থিতিতেও পণের টাকা ফিরে দেওয়া কালিদাসবাবুর দাপট মনে দাগ কেটে যায়, স্বল্প উল্লেখেও আইডিয়ালিস্ট সুনন্দার প্রতি পাঠকের সমীহ এবং আগ্রহ দুইই প্রবল হয়ে ওঠে। 

যা হোক, কৈশোরে শ্রীকান্তর পাশাপাশিই পড়েছিলাম রবিবাবুর গোরা। এই দুই বইয়ের মধ্যে যোগাযোগ বলতে আমার সেই “পাশাপাশি পড়ার” স্মৃতিটুকু। গোরার (বইয়ের কথা বলছি, ব্যক্তি নয়) সুচরিতা আর শ্রীকান্তর (বইয়ের কথা বলছি, ব্যক্তি নয়) রাজলক্ষ্মীর মধ্যে কত তফাৎ। অথচ ফের যখন পাশাপাশি এই দুই বই শেষ করলাম তখন মনে হচ্ছে আইডিয়ালিজমের প্রতি নিজেকে সৎভাবে সঁপে দিতে পারা এমন সরল দুজনের মানুষ যেন একে অপরের কতটা কাছের। পাঠক হিসেবে বয়সের মরচে আর জ্যাঠামোর কথা উল্লেখ করেছিলাম; কোন চরিত্র কতটা “রিয়েল” তা নিয়ে চুলচেরা বিচার করে চোখমুখ কুঁচকে দুচারটে গম্ভীর মন্তব্য করতে না পারলে যেন তৃপ্তি হয়না। সেই পয়েন্ট অফ ভিউ থেকে বলতেই পারি যে “ধুস, এদের সবেতেই বড্ড বাড়াবাড়ি”। এমন আইডিয়ালিজমে সঁপে দেওয়া চরিত্র হয়ত আজকালকার লেখায় তেমন সহজে নজরে পড়ে না; কারণ তাঁদের স্নেহ, বিশ্বাস ও ত্যাগ যেন কিছুতেই “রিয়াল” বলে বিশ্বাস হয় না। কিন্তু স্বীকার করে নিই যে এ’দুজনকেই ভালো না বেসে থাকা যায় না (আমি অন্তত পারিনি); এঁরা নিজেরা ‘আনরিয়াল’ হতে পারেন কিন্তু পাঠক হিসেবে এদের প্রতি আমার ভক্তিটা ষোলোআনা ‘রিয়াল’। তবে রাজলক্ষ্মী চরিত্রটা আমার বেশি প্রিয়; খানিকটা ওই যুক্তি পেরিয়ে সঞ্জীবকে ভালোবাসার মত। এ বই ফের পড়তে পড়তে আনন্দ সন্ন্যাসীর ওপর খানিকটা হিংসেই হয়েছে; রাজলক্ষ্মীর চ্যালা হয়ে ঘুরঘুর করতে পারলে বোধ হয় কৈলাস ভ্রমণের তৃপ্তি লাভ করা যায়। 

পৃথিবীর সমস্ত গল্পকথা সত্যি হলে নিশ্চিন্তে বলতে পারতাম যে রাজলক্ষ্মীই পরজন্মে “ইতি তোমার মা” গল্পে বুড়োর মা হয়ে জন্মেছেন; শেষ চিঠির সেই স্নেহে যে রাজলক্ষ্মীরই সুবাস মিশে। আর যেহেতু রাজলক্ষ্মীর ভালোবাসা শতজন্মেও ম্লান হওয়ার নয়, সেহেতু এও হলফ করে বলাই যায় যে বুড়োর বাবাটিই আদতে জন্মান্তরের শ্রীকান্ত।  

পুনশ্চঃ 
একটা খুঁতখুঁত আর সামান্য ঘ্যানঘ্যান। 
শ্রীকান্তর বর্মা-ডায়েরীটা শরৎবাবু আরও একটু দীর্ঘ করতেই পারতেন; শ্রীকান্ত উপন্যাসে ওটাই আমার সবচেয়ে প্রিয় অংশ যে।

Comments

ghonada said…
ei prosonge ekta kotha boli : "Iti polash " golpo ta apnar kamon lagechilo ?

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু