Skip to main content

জ্যানেট রিজভির লাদাখ


ট্র্যাভেলার হিসেবে আমি একশোয় তেরো পাবো কিনা সন্দেহ। ঘুরতে গিয়ে বাড়ির আরাম খুঁজি, জিনিস হারাই, নেটফ্লিক্স/প্রাইমে ডাউনলোড করা সিনেমা সিরিয়াল দেখি, বই পড়ি; মোদ্দা কথা ছুটির দিনে বাড়িতে বসে অন্য কিছু করি বলে তো মনে হয়না।
তবু বছরে কি দেড়-বছরে একবার; প্রায় হপ্তাখানেকের জন্য সপরিবারে কোথাও না কোথাও ঘুরতে যাই আর কয়েক হাজার বেকায়দা ভাবে তোলা ফটোতে মোবাইল বোঝাই করে বাড়ি ফিরি। এই যেমন এ'বারে গেছিলাম লাদাখে। শ্বেতার তত্ত্বাবধানে পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়ার একটা বড় সুবিধে হল যে সে "হোম-স্টে"গুলো জোগাড় করে বেশ দেখেশুনে। রহিসি না থাক, সে'সব জায়গায় আরাম আর উষ্ণতার অভাব থাকেনা।
তা এ'বারের ঘোরাঘুরির একদম শেষের দিকে দিন দেড়েকের জন্য আমরা ছিলাম পশ্চিম লাদাখের হেমিস-শুকপাচান বলে একটা গ্রামে। সে'খানে উঠেছিলাম শেরিং তোন্ডুপ নামগ্যালের বাড়িতে (বাংলা বানানে লিখতে গিয়ে ফোনেটিক্সে গোল পাকালাম কিনা কে জানে)। ভদ্রলোকের বয়স সত্তর বাহাত্তর; মিষ্টভাষী এবং সদালাপী, মামার ভাষায় "ভারী মাই ডিয়ার মানুষ"। ভদ্রলোক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ছিলেন, চাকরী থেকে অবসর নিলেও আশেপাশের মানুষকে শিখিয়ে-পড়িয়ে নেওয়ার অভ্যাসটুকু ত্যাগ করেননি। সন্ধ্যে নাগাদ তাঁর ডাইনিং হলে বসিয়ে দিব্যি একটা ছোটখাটো লেকচার দিয়ে দিলেন লাদাখ অঞ্চলের ইতিহাস এবং সংস্কৃতির ব্যাপারে। ভদ্রলোক এই বয়সেও 'কিউরিওসিটি'তে ভরপুর; কলকাতা নিয়ে তার পালটা প্রশ্নও কম প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু দেখা গেল ভদ্রলোক লাদাখ সম্বন্ধে যতটা জানেন, আমি বাংলা বা কলকাতা সম্বন্ধে তার সিকিভাগও জানিনা। গল্পগুজব শেষে ভদ্রলোক নিজের বইয়ের শেলফ থেকে আমায় একটা বই ধার দিলেন; লাদাখের ইতিহাসের ওপরই, পাতলা বই, একদিনের মধ্যে নিশ্চিন্তে পড়ে শেষ করে ফেলা যায়। লাদাখ (এবং ওই হেমিস শুকপাচান গ্রামটা) এতটাই সুন্দর যে আমার মত গাম্বাট মানুষও মাঝেমধ্যেই 'আহা কোথায় এসে পড়লাম' বলে গলে পড়ছি। তাছাড়া ঘোরার পথে বিভিন্ন গোম্পা দেখেটেখে স্বাভাবিক ভাবেই জায়গাটার ইতিহাস সম্বন্ধে একটু আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। কাজেই তোন্ডুপ সাহেবের দেওয়া বই সাগ্রহে গ্রহণ করে জোড়া-কম্বলের তলায় সেঁধোলাম। বইটা যথাসময়ে শেষ করতে পেরেছিলাম।
জ্যানেট রিজভির লেখা "লাদাখ, ক্রসরোডস অফ হাই এশিয়া" সম্বন্ধে দু'চারটে কথা:
১। আমি বইটার ১৯৮৯ এডিশন পড়েছি। প্রথম প্রকাশ সম্ভবত তিরাশিতে। কিন্তু বইটার মূলে যেহেতু রয়েছে লাদাখের ইতিহাস এবং কালচার; সেহেতু পুরনো এডিশন বলে তেমন একটা হোঁচট খেতে হয়নি। লেখিকার ভাষার সারল্য মনে ধরেছে; স্যাম্পল হিসেবে প্রথম আট দশ পাতা পড়ে সহজেই ঠিক করে নিলাম যে এ বই টানা পড়ে শেষ করতেই হবে।
২। লাদাখের ভূগোল, ইতিহাস, সংস্কৃতি; এ সমস্ত নিয়েই এই বই। প্রাইমার হিসেবে অতুলনীয় বলেই মনে হল। আজকাল গুগল সহজলভ্য ইনফরমেশনে ভরপুর; এ যুগে দাঁড়িয়ে ৩৫/৩৬ বছর আগে লেখা এমন বিষয়ের একটা বইকে "রেলেভ্যান্ট" আর "এনরিচিং" মনে হওয়াটাই একটা চমৎকার ব্যাপার।
৩। পাহাড়ে ঘেরা এই নিরিবিলি প্রান্তরে বসে রাজরাজড়ার ইতিহাস, পলিটিক্স, যুদ্ধ, বিদ্রোহ, বাণিজ্য ইত্যাদি নিয়ে পড়তে পড়তে গোটা ব্যাপারটা বেশ সাররিয়াল ঠেকে। তিব্বতের সঙ্গে যোগাযোগ থেকে ডোগরাদের আক্রমণ থেকে পশমিনা নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া; এ সমস্ত মিলে তিব্বতি রাজাদের (ও তাঁদের প্রজাদের) কম হ্যাপার সামলাতে হয়নি। সে ইতিহাস ক্ষেত্র বিশেষে জটিলও বটে। লেখিকা সেই আপাত-জটিল ইতিহাস খুব সহজ ভাবে আর স্বল্প পরিসরে বর্ণনা করেছেন, বলেছেন কাশ্মীর বা বাল্টিস্তানের সঙ্গে লাদাখের যোগাযোগ ও বিচ্ছেদের কথাও।
৪। বইয়ের অন্যতম জরুরী অংশ হল তিব্বতের সঙ্গে লাদাখের যে আত্মার যোগ; সেটুকুর ইতিহাস আর বর্তমানকে তুলে ধরা। আর সেই প্রসঙ্গে উঠে এসেছে লাদাখি বৌদ্ধধর্মের প্রসঙ্গ, তিব্বতের সঙ্গে তার নিবিড় যোগাযোগ এবং সূক্ষ্ম অমিলগুলো। চমৎকার ভাবে আলোচিত হয়েছে বিভিন্ন গোম্পা, তাদের ইতিহাস ও স্থাপত্য।
৫। আমার মতে এ বইয়ের সবচেয়ে সুন্দর অংশটি হল লাদাখের সাধারণ মানুষের জীবনধারা নিয়ে লেখা অধ্যায়গুলো। তাঁদের খাবারদাবার, কালচার, পোশাক, দৈনন্দিন জীবনের সারল্য, গ্রাসাচ্ছাদনের লড়াই এবং আধুনিকতার (ভালো ও মন্দ) প্রভাব; এই সমস্তই বড় চমৎকার ভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
লাদাখের প্রত্যন্ত গ্রামে বসে, শীতে কাঁপতে কাঁপতে এই বই পড়ার অভিজ্ঞতাটা সত্যিই অনন্য। বইটা লাদাখ সম্বন্ধে আমার আগ্রহ এতটা উস্কে দিয়েছিল যে ফেরার পথে লেহ্‌ শহরের একটা জমকালো বইয়ের দোকানে ঢুঁ মেরেছিলাম লাদাখ সম্বন্ধে আরও ভালো কিছু বইয়ের খোঁজ করতে। লাদাখের ওপর সবচেয়ে ভালো বই কী আছে জিজ্ঞেস করাতে দোকানি-মশাই নির্দ্বিধায় জানালেন;
"সব সে পপুলার অউর সব সে অথেন্টিক বুক অন দিস এরিয়া; জ্যানেট রিজভি কা লাদাখ"।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু