Skip to main content

থ্রিলিং


- কী রে!
- আরে সুশান্তদা যে..।
- কদ্দিন পর তোকে পাড়ায় দেখছি রে দীপু, ফিরলি কবে?
- আজ সকালেই।
- পুজোয় এলিনা এ'বারেও...।
- যথারীতি, ছুটিই পেলাম না।
- বাঙালিকে পুজোয় বাড়ি ফিরতে না দেওয়ার ব্যাপারটা কন্স্টিটিউশন অ্যালাউ করে?
- হেহ্।
- অবিশ্যি পুজোয় তোদের ব্যাচের কাউকেই দেখিনি এ'বার...সবাই আজকাল এক্কেবারে শশব্যস্ত..তাই না রে?
- তোমার খবর কী সুশান্তদা?
- আমি অঙ্কের টিউশনি করা মাস্টার। মাস্টারি করেই হেঁদিয়ে মরা ছাড়া আর গতি কী বল।
- মনে আছে সুশান্তদা, দামোদরের ও'দিকে যে'বার পিকনিক করতে গেছিলাম; মাংস রান্নার ফাঁকে তুমি প্রবাবিলিটি বুঝিয়েছিলে আমাদের?
- ব্যাপারটা যে তুই মনে রেখেছিস, সে'টাই বড় কথা। যাক, দেখা যখন হয়েই গেল; দু'পা এগোনো যাক। এখন রাত সাড়ে ন'টা, কাজেই রাজেনদার দোকান এখনও খোলা আছে। একটা করে রোল খাওয়া যাক বরং? নাকি মাংসের চপ?
- তোমার রোল। কিন্তু আমার রুটিনে কিন্তু হাফপ্লেট চাউমিনই পড়ে। ডিম দিয়ে। সঙ্গে এক্সট্রা লঙ্কাকুচি।
- তাই হবে।
- আর হ্যাঁ। একসময় তোমার ছাত্রদের কম রোল-চাউমিন খাওয়াওনি রাজেনদার স্টল থেকে। এখন আমরা কিছুটা হলেও লায়েক হয়েছি। আজ কিন্তু আমি খাওয়াব সুশান্তদা।
- বহুত খুব শাহজাদা দীপক, বহুত খুব।
***
সুশান্তদার এগরোল চেবানোর দৃশ্যটা দীপুর যে কী ভালো লাগছিল। লোকটা আগের চেয়ে অনেকটা বুড়িয়ে গেছে কিন্তু মেজাজটা আগের মতই দরাজ। নিজের হাফ প্লেট চাউমিন শেষ হতেই রাজেনকাকুকে খান চারেক মাংসের চপ ভাজতে বলে দিল দীপু।
বাতাসে মৃদু ঠাণ্ডার স্পর্শ এসে পড়েছে, সদ্য কড়াই থেকে তোলা মাংসের চপগুলো যখন রাজেনকাকু তাঁদের সামনে রেখে গেল তখন দীপু নিজের জিভের ডগার চনমনটা টের পেল। ছাতিমের গন্ধের সঙ্গে ওই রাজেনকাকুর স্পেশ্যাল মাংসের চপ ভাঙা ধোঁয়া মিলে তখন তার মাথার মধ্যে একটা ভালোলাগা রিমঝিমে ভাব।
সুশান্তদা ততক্ষণে সাহিত্য আর জ্যামিতির মেলবন্ধন নিয়ে কিছু একটা বলতে শুরু করেছিল; কিন্তু দীপু ব্যাপারটাকে ঠিক হৃদয়ঙ্গম করতে পারছিল না। যদিও সে সুশান্তদার কথাগুলো বেশ মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করছিল, কথাগুলো শুনতেও খারাপ লাগছিল না। সুশান্তদার হাত নেড়ে, চোখ গোলগোল করে কথা বলার স্টাইলটাও পাল্টায়নি। দিব্যি লাগছিল দীপুর।
তবু সুশান্তদার কথার মাঝেই দীপুকে ফুট কাটতে হল।
- সুশান্তদা..।
- কী?
- একটা কথা বলার ছিল।
- বলে ফেল..। 
- তোমার কাছে পড়ার সময়..ইয়ে...মানে...মানে..আমি মাঝেমধ্যে তোমার মাসমাইনের টাকা থেকে তিরিশ বা চল্লিশ টাকা সরিয়ে নিতাম। তুমি কোনোদিন টাকা গুনে নিতেনা তাই...আমি, মন্টু, বিপুল, রণজিৎ; আমরা সবাই মাঝেমধ্যে টাকা সরাতাম...আর সেই সরানো টাকা গোটাটাই খরচ হত রাজেনকাকার রোল চাউমিনে।
- হা হা হা হা হা..।
সুশান্তদার অট্টহাসি বহুক্ষণ ধরে চলল। দীপুকেও সে হাসিতে যোগ দিতেই হল। বহুদিন ধরে এই খুচরো অপরাধবোধটা বয়ে বেড়াচ্ছিল সে; টিউশনির মাইনে থেকে টাকা সরানো তো এক ধরনের চুরিই। ছেলেবেলায় এ নিয়ে বিশেষ মাথা না ঘামালেও, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ নিয়ে মনের মধ্যে বেশ একটা খচখচ তৈরি হয়েছে। নেহাত সুশান্তদা নিপাট ভালোমানুষ, কিন্তু তাই বলে এমনভাবে তাঁকে ঠকানো? এত বছর পরেও সে অপরাধবোধটুকু উড়িয়ে দিতে পারেনি দীপু। কিন্তু আজ সুশান্তদার ওই প্রাণখোলা হাসির ঝাপটায় দীপুর বুকের ওপরে রাখা পাথরটা সরে গেল; সুশান্তদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেও হেসে উঠল।
আর তখনই ভেসে এলো রাজেনকাকার কণ্ঠস্বর। রাত তখন সোয়া দশ, দোকানের বেঞ্চি আর রাস্তা দু'টোই শুনশান।
- কী ব্যাপার রে দীপু, তখন থেকে দেখছি একাএকা বিড়বিড় করছিস, এখন আবার অকারণে হাসছিস। নেশাভাংটাং করেছিস নাকি?
- ধুস। না। জানো রাজেনকাকা, আচমকা বেশ নিশ্চিন্ত বোধ করছি।
- নিশ্চিন্ত? কে জানে বাবা। তা, আর কিছু নিবি? এ'বার ঝাঁপ বন্ধ করব।
- না, কাজ হয়ে গেছে। আমিও উঠি। কত হল?
- হাফ ডিম চাউমিন, একটা ডবল এগরোল আর চারটে মাংসের চপ। সব মিলে একশো দশ।
- এই যে।
- বহুদিন পর পাড়ায় দেখলাম তোকে দীপু।
- ছুটিটুটি পাই কোথায় যে আসব। আচ্ছা রাজেনকাকা, তোমার সুশান্তদাকে মনে পড়ে?
- অঙ্ক মাস্টার? আহা, বড় ভালোমানুষ ছিল৷ সবই অদৃষ্ট। নইলে অমন জলজ্যান্ত লোকটা সাপের কামড়ে পট করে...। হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছনোর আগেই সে...। ইশ্। গতবছর পর্যন্ত রোজ সন্ধেবেলা এই বেঞ্চিতে এসে গ্যাঁট হয়ে বসে কত গল্প করেছে। রোজ। আর নিয়ম করে রোজ ডবল এগরোল। রোজ।
- তোমার এগরোলের টান যে অসীম রাজেনকাকা।
হেঁয়ালিপূর্ণ কিছু নিয়ে মাথা ঘামানোর ব্যাপারে রাজেনকাকার কোনোদিনই আগ্রহ নেই। কাজেই দীপুর কাছে সে জানতে চাইল না যে "এগরোলের অসীম টান" ব্যাপারটা কী। অবশ্য জানতে চাইলেও দীপু তাকে ব্যাপারটা বোঝাতে পারত কিনা কে জানে।
রাজেনকাকার দোকান থেকে বেরিয়ে শুনশান অন্ধকার রাস্তায় এসে দাঁড়ালো দীপু। সুশান্তদার কাছে নিজের দোষ স্বীকার করতে পেরে সে সত্যিই নিশ্চিন্ত বোধ করছে আজ।
তাছাড়া; এর আগে নিশ্চয়ই কেউ কোনোদিনও এগরোলকে প্ল্যানচেটের মিডিয়াম হিসেবে ব্যবহার করে উঠতে পারেনি! প্ল্যানচেটের দুনিয়ায় একটা যুগান্তকারী ঘটনা আজ ঘটেছে তারই হাত ধরে; 'থ্রিলিং' শব্দটা বার তিনেক আউড়ে নিল সে।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু