Skip to main content

রাতের মেজাজ


রাত যত গভীর হয়, কিছু মানুষের মেজাজ তত খোলতাই হয়। মাঝরাত পেরোলেই তাঁরা আরো চাঙ্গা হয়ে ওঠেন, তাঁদের ফাঁদা গল্পের ধার বেড়ে যায়, গলায় সুর এসে ঠেকে, ঠাট্টাগুলো পেরেকের ঠিক মাথায় এসে বসে; মোট কথা গভীর রাতের ছোঁয়াচ লাগলেই তাঁরা হঠাৎ মনে পড়া পদ্যের মত উজ্জ্বল হয়ে ওঠেন।

মনোময় মল্লিক তেমনই একজন। মেসের প্রতিটি রাত গড়িয়ে ভোর হওয়া আড্ডার মধ্যমণিও তিনি৷ চাকুরেদের মেস, কাজেই শনিবারের রাত ছাড়া এমন জমাটি রাতকাবার করা আড্ডা খুব বেশি বসে না। ট্যুয়েন্টি নাইন, দাবা; শুরুটা মাপা সুরে হলেও ক্রমশ এ জমায়েত রংবিরঙ্গি হয়ে ওঠে নির্ভেজাল আড্ডায়। রেলের ক্লার্ক মেহবুব আর উঠতি সাংবাদিক অখিলেশের সারাক্ষণ শুধু পলিটিকাল ডিবেট নিয়েই হদ্দ। প্রাইভেট ফার্মের চাকুরে দেবনাথ কথায় কথায় গান ধরেন, গলায় সুরও আছে বটে৷ সহদেব হালদার ক্রিকেট কোচিং করান কলকাতারই একটা ক্লাবে, খেলাধুলোর ব্যাপারে মতামত সকলেরই থাকে তবে সহদেবের টেবিল চাপড়ে বলা কথার ওপর সাধারণত কোনো তর্ক চলেনা। নির্মল হালদার আর অসীম মাইতি দু'জনেই একই ব্যাঙ্কে একই পদে বহাল; দু'জনেই শুধু খাইয়ে নন, ভালো খাবারদাবারের কন্যোসার, তাঁদের আলোচোনার সিংহভাগ জুড়ে শুধু খাবারদাবার আর খাওয়াদাওয়া। আর সবাইকে একই সূত্রে বেঁধে এইসব আড্ডার সুর রচনা করে থাকেন মনোময়।

মনোময় ছাড়া রাতের আড্ডা হল ঝালের আস্তরণ ছাড়া মেসের ঠাকুরের রান্নার মত; পাতে দেওয়া চলেনা। রাজনৈতিক তর্কাতর্কির গোলমাল কাটিয়ে টেনিদা-সম ডাম্বেল-মার্কা ফিচলেমো আড্ডাবাজদের দিকে ঠেলে দেন তিনি। শ্যামসঙ্গীত শুনে তাঁর চোখ ছলছলিয়ে ওঠে আর গজল শুনে তিনি ফেলে আসা প্রেমের স্মৃতিতে নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়ার উপক্রম করেন; গানের সুরের চেয়েও মধুময় হয়ে ওঠে তাঁর অন্তর থেকে বলে ওঠা 'বাহ্'। খেলাধুলোর প্রসঙ্গে তিনি খুব সহজে টেনে আনেন সাহিত্য; সহদেব হালদার আজহারউদ্দিন প্রসঙ্গে জোরালো কোনো মন্তব্য করলে তিনি অবলীলায় মতি নন্দী কোট করে আলোচনায় অন্য ডাইমেনশন জুড়ে দেন। খাবারদাবার নিয়ে রসালো আলোচনায় অবলীলায় সুকুমার রায়ের ছড়া বা জয় গোস্বামীর প্রেমের কবিতা মিশিয়ে দেওয়ার কলজে রাখেন মনোময়। মোদ্দা কথা হল রাতের এই মেসমাতানো-আড্ডাগুলোয় মনোময়ের উপস্থিতি হল শীতকালে দুপুরের রোদ খাওয়ানো লেপের ওমের মত। মনোময় না থাকলে আড্ডা রাত বারোটার-সাড়ে বারোটার বেশি গড়ায় না অথচ মনোময়পূর্ণ শনিবার রাত্রের কত আড্ডা ভেঙেছে ভোরের ফর্সা আকাশ দেখে।

দিনের বেলাগুলো অবশ্য মনোময় রীতিমতো ম্রিয়মাণ, গোটা সকালটা তার মুখে তেমন একটা বুলি ফোটেনা। বুলি ফোটানোর তেমন তাগিদও বোধ করেননা তিনি।

তাগিদটা আসে রাত বাড়লে। রাত যত গভীর হয় তত মানুষের সঙ্গলাভের জন্য উন্মুখ হয়ে পড়েন মনোময়। বিশেষত শনিবার রাত্রিগুলোয় এমন আড্ডার কোকেন রক্তে গ্রহণ না করতে পারলে মনোময়ের বুকের ভিতরটা টনটন করে ওঠে; মনে হয় বাক্সে রাখা মায়ের চিঠিটা খুনে ছুরি হয়ে বুকে এসে বসবে।

"খোকা,
বড় কষ্টে এ চিঠি লিখছি। কিন্তু বুক ফেটে গেলেও এ চিঠি আমায় লিখতেই হবে।
তোকে কাছে টেনে রাখা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। তোর বাবা বলে এদ্দিন নাকি তোকে আগলে রেখে আমি অন্যায়ই করেছি। কিন্তু মায়ের মন; অত সহজে স্বস্তি পাই কী করে? বুকে পাথর রেখে তোকে বিদেয় করতে হয়েছে খোকা, কিন্তু বিশ্বাস কর এ অসহ্য যন্ত্রণা আমি আর সহ্য করতে পারিনা।
নিমু তান্ত্রিক খবর দিয়েছে তুই এখনও মায়া কাটিয়ে যেতে চাইছিস না। এ চিঠি আমি ওর মারফতই তোকে পাঠালাম, পোস্টঅফিসের সাধ্য কী এ চিঠি তোর কাছে পৌঁছে দেবে? বেঁচে থাকতে কোনোদিন তুই একটা মিছে কথাও বলিসনি, আজ তবে মানুষ সেজে অন্যদের ঠকানো কেন বাবা! আমি মা হয়ে জানি যে এতে কোনোমতেই তোর যন্ত্রণা কমছে না।

নিমু বলেছে যে যে কোনো শনিবার রাত্রে তুই ওর কাছে ফিরে এলেই ও তোর মুক্তির ব্যবস্থা করে দেবে। আর নিজেকে ঠকাসনে, অন্য মানুষগুলোকেও এ'বার মুক্তি দে।

ইতি তোর মা"।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু