Skip to main content

স্মৃতি ও স্বাদ



স্বাদবোধ, সঙ্গীতপ্রেম, সাহিত্যপ্রীতি।
এ'সবকিছুই যদি স্প্রেডশিট আর আইনকানুন মেনে হত তা'হলে তো জীবনের প্রতিটি কণাই পিরিওডিক টেবিলের মত অমোঘ হয়ে রইত। অতি সাধারণকে 'এইটা আমার' বলে আঁকড়ে ধরার দুঃসাহস মানুষের আছে বলেই আমাদের ভালোবাসা এখনও অ্যালগোরিদমে বাঁধা পড়েনি৷।
স্বাদ প্রসঙ্গেই বলি৷
এক্সাইড ব্র্যান্ড আর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মোমোর এক নিবিড় যোগাযোগ; সে'টা আজও দিব্যি টের পাই৷ প্যাভলভের কুকুর ঘণ্টার টুংটাং শুনলেই সুস্বাদু মাংসের কথা ভেবে লালা ঝরাতো৷ আর আজকাল কোথাও ভালো মোমো চাখা মাত্রই আমার মনের মধ্যে ভেসে ওঠে কলেজ-বয়সের এক্সাইড-রবীন্দ্রসদন মোড়ের ছবি৷ সবুজ বা লাল প্লাস্টিকের প্লেটে মোমো আর কন্ট্রাস্টিং লাল বা সবুজ প্লাস্টিকের বাটিতে সাদা জলজলে স্যুপ৷ আমার প্রথম মোমো খাওয়া সে'খানেই৷ সে মোমোর আদত স্বাদ তেমন মনে নেই, মনে থাকার কথাও নেই। কিন্তু ওই; সুখস্মৃতি তো আর মিলিটারি নিয়মে কুচকাওয়াজ করে চলাফেরা করে না। জুলাই মাসের খতরনাক গরম আর ফুটপাথের প্রবল ঠেলাঠেলি উপেক্ষা করে হুসহাস করে আগুন গরম স্যুপ খাচ্ছি আর কলজে কাঁপানো ঝাল লঙ্কার সসে মোমোয় মাখিয়ে মুখে চালান করছি; এই হাই-ভোল্টেজ স্মৃতিতে সহজে মরচে পড়বে না৷
আবার ধরা যাক গ্রেভি চাউ৷ ২০০১ বা ২০০২, বড়বাজারের সরস্বতী (সম্ভবত) নামের এক রেস্তোরাঁয় আমি প্রথম গ্রেভি চাউমিন চেখেছিলাম। আমি ঝোলে-ভাতে চিরকাল মানুষ৷ হয়ত সে সূত্রেই ঝোল মাখানো চাউমিনের সঙ্গে অতি সহজেই যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল৷ বলাই বাহুল্য, সেই রেস্টুরেন্ট ঠিক আদর্শ চাইনিজ নয়৷ অর্থাৎ সেখানে পোলাও, দোসা, ফ্রায়েড রাইস সবই ছিল। তবে সাদাটে ঝোল ঝোল ব্যাপারের মধ্যে চাউমিন, সেই অনাবিল অভিজ্ঞতা তার আগে কখনও হয়নি৷ এরপর যখন কলেজে ভর্তি হয়ে কলেজস্ট্রিট লাগোয়া মেসবাড়িতে গিয়ে উঠলাম, তখন পকেটে বাড়তি দু'পয়সা জমলে সূর্য সেন স্ট্রিটের বীণা রেস্টুরেন্টে গিয়ে গ্রেভি চাউ অর্ডার করতাম৷ অতি সাধারণ রেস্টুরেন্ট, কিন্তু সে সময় সে'টাই 'লাক্সারি'র পর্যায় পড়ত৷ সেই চাউয়ের গ্রেভি বিভিন্ন সসে পরিপূর্ণ, কটকটে ঝাল৷ তবে সে স্বাদের সঙ্গে সে'সময়ের ভালোবাসা মিশে আছে৷ মেসবাড়িতে থাকার সময় আর এক সহজ 'চাইনিজ' গন্তব্য ছিল খোকনদার কেয়ার অফ ফুটপাত চাউমিন স্টল। খোকনদা গ্রেভি চাউ বানাবে কী করে, কেতাবি গ্রেভি নুডলস সম্বন্ধে হয়ত ওর কোনও ধারণাই ছিল না৷ কিন্তু চাইলেই হাফ-প্লেট চাউমিনের ওপর এক হাতা চিলি চিকেনের লালচে ঝোল ছড়িয়ে দিত৷ সে' স্বাদও অনন্য। স্বাভাবিক কারণেই, মেসের জনতার জন্য খোকনদা ছিলেন পরমাত্মীয়৷ "আর একটু গ্রেভি দেব নাকি ভাই, চিলিটা একদম টাটকা নামিয়েছি", খোকনদার এই দরাজ 'অফারে'র স্মৃতিই আমার জন্ম-জন্মান্তরের চায়নাটাউন৷

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু