অনির্বাণ কম্পিউটারটা শাটডাউন করে অফিসের চেয়ারটায় গা এলিয়ে দিলেন। এখন রাত সোয়া দু'টো। অবশেষে প্রজেক্ট রিপোর্ট সাবমিশন হলো। গোট অফিসে এ সময়ে মাত্র দু'জন, অনির্বাণ আর পিওন সুমিত। সুমিত নিশ্চয়ই এতক্ষণে প্যান্ট্রিতে এক রাউন্ড ঘুম সেরে নিয়েছে। গোটা দিন যা ধকল গেছে, সে বেচারাকে দোষ দেওয়া যায় না। এ'সময়ে এক কাপ কফি হলে মন্দ হতো না কিন্তু সুমিতকে বিরক্ত করতে ইচ্ছে হলো না। নিজে প্যান্ট্রিতে ঢুকে এক কাপ ব্ল্যাক কফি বানিয়ে নেওয়াই যায় কিন্তু তা'তেও নির্ঘাৎ সুমিত ব্যাটার তন্দ্রায় ব্যাঘাত ঘটবে।
পাশে রাখা জলের বোতল, সে'খান থেকেই দু'ঢোক গলায় দিয়ে কফির তেষ্টাকে বাগে আনার চেষ্টা করলেন অনির্বাণ। রিপোর্টটা বেশ ভালোই তৈরি হয়েছে। তা'ছাড়া পর পর তিন রাত জেগে কাজ করার ব্যাপারট টীমে কারুর নজর এড়াবে না। দু'একটা পিঠ চাপড়ানি, "এবার একটু রেস্ট নাও" গোছের স্নেহ-মিশ্রিত কঙ্গ্রাচুলেটরি কথাবার্তা; এ'সব জুটবে। সুকুমারদা তো রিপোর্ট পড়ে অন্তত একবার ওঁর সেই উদার কণ্ঠে "ব্রাভো" বলবেনই। এ'সব ভেবে একটা বেশ তৃপ্তি অনুভব করছিলন অনির্বাণ।
সবাই ভাবে অনির্বাণ কেরিয়ার বলতে পাগল। সবাই ভাবে অনির্বাণ অফিসের একজন "গুড বয়"। ভবিষ্যতের বোর্ডরুমের একটা চেয়ার তাঁর মত ব্রাইট চ্যাপের জন্য নির্ঘাৎ রিজার্ভ করা আছে। কিন্তু অনির্বাণ নিজে মনে মনে জানেন যে কেরিয়ারের প্রতি তাঁর সবিশেষ আগ্রহ নেই। চেয়ারম্যান ডিরেক্টর হওয়ার কথা ভাবলেও তাঁর গায়ে জ্বর আসে। কিন্তু সহকর্মী অভীকের "কী করে এতো খাটতে পারো তুমি অনিদা" অথবা ওই সুকুমারদার "ব্রাভো"- এ'রকম হাজারখানা অদরকারী মৃদু-প্রশংসা আদায় করে নেওয়া ব্যাপারটা ভালো লাগে অনির্বাণের। বারবার মনে হয়, "এইত্তো, ওরা আমায় দেখছে। আমার চেষ্টাগুলো জলে যাচ্ছে না। একজন মানুষের খাটনি ওদের চোখে পড়ছে"। এই "চোখে পড়ছি" আশ্বাসটা একটা বিরাট মায়ার মত টেনে রাখে তাঁকে। সেই টানেই রোজ এই অফিস ছুটে আসার প্রতি তাঁর এত আগ্রহ।
সাতপাঁচ ভাবনার সুতো আচমকা ছিঁড়ে গেলো খটাস শব্দে। সুমিত কফির কাপ রেখেছে সামনে। "বাঁচালে ভাই সুমিত", অস্ফুটে অনির্বাণের আন্তরিক কৃতজ্ঞতাটা প্রকাশ পেলো।
"এমন খাটছেন স্যার, কফি-টফির দায়িত্বটা তো অন্তত আমায় নিতে হবে নাকি"।
"কাজ কিন্তু শেষ সুমিত, তুমি এবারে এসো। এত রাত্রে ফিরতে অসুবিধে হবে না তো"?
"স্কুটার আছে তো। ফাঁকা রাস্তায় বড়জোড় মিনিট কুড়ি। আপনিও বেরোবেন তো"?
"এই। এখুনি। তুমি এগোও"।
সুমিত চল গেলো। এ'বারে বাড়ি ফেরাই যায়। কিন্তু রোজকার মত আজও ছুটে ফেরার আগ্রহটা টের পেলেন না অনির্বাণ। সুকুমারদা, অভীক, সুমিত; এর অনির্বাণের কেউ নন। তবু, অসময়ের কফি আর ছেঁদো ব্রাভোর প্রতি অনির্বাণের বড় লোভ; ওটুকুতেই তাঁর নিজেকে দেখতে পারা।
অস্বস্তিটা সরিয়ে রেখে কম্পিউটারটা স্যুইচ অন করলেন অনির্বাণ।
No comments:
Post a Comment