Tuesday, December 5, 2023

ছোটদের লেখা



কিশোরভারতীর আত্মপ্রকাশের বছর তিনেকের মাথায় প্রথম পুজোসংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালের অক্টোবর মাসে, দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায়।

সম্প্রতি  পত্রভারতীর তরফ থেকে সে'সংখ্যাটি বইয়ের আকারে নতুন ভাবে ছেপে বের করা হয়েছে। এই ধরণের জরুরী কাজ দেব সাহিত্য কুটীরও করে চলেছে পুরনো শুকতারাগুলো নতুন করে ছেপে৷ 

যা হোক, যে'কথাটা বলতে এই পোস্ট৷ ছোটরা যথেষ্ট বাংলা গল্পের বই ও পত্রিকা পড়ছে কিনা, এ নিয়ে আমরা প্রচুর আলাপ-আলোচনা শুনতে পাই৷ সে আলোচনাগুলো জরুরীও বটে৷ সব ভাষাতেই চিরকাল তেমন বিশ্লেষণ হয়েছে, আরও হবে৷ এর পাশাপাশি ছোটদের আমরা কী পড়তে দিচ্ছি, সে'সম্বন্ধেও জোরদার আলোচনা হবে এমনটাই  কাম্য।

সদ্য কেনা সেই নতুন করে প্রকাশিত প্রথম কিশোরভারতী পুজোসংখ্যার সম্পাদকীয়টি পড়লাম৷ ছোটদের জন্যই লেখা; সুমিষ্ট ও সরল। কিন্তু সে'লেখায় বাবা-বাছা করে সেরেল্যাক গুলে খাইয়ে দেওয়া নেই। বরং ঝরঝরে স্মার্ট ভাষায় সম্পাদক দাগিয়ে দিয়েছেন কিশোরভারতী কী এবং কেন৷ এবং তার চেয়েও বড় কথা; ধারালো সব বক্তব্য রাখঢাক ছাড়াই পেশ করা হয়েছে৷ ছোটছেলেমেয়েদের কাতুকুতু আর আশীর্বাদ ছাড়াও অনেক কিছু দেওয়ার আছে, সে দায়িত্ব এড়িয়ে যাননি সম্পাদক৷ সে'খানেই আমাদের কতকিছু শেখার। 

সে সম্পাদকীয়র কিছুটা অংশ তুলে দিলাম; বড়দের জন্য৷ এ'টা মনে করিয়ে দিতে যে এই লেখা অনায়াসে ছোটদের পাতে দেওয়া হত এককালে (এখন হয় না তা বলছি না, আমি কতটাই বা পড়ি - তবে এমনটাই আরও হওয়া উচিৎ)। এ'ভাবেই ছোটদের মন জয় করা সম্ভব; কারণ ওরা আমাদের চেয়ে ঢের বেশি স্মার্ট- জগতসংসারের নিয়মই তেমন।

তিপ্পান্ন বছর আগেকার ছোটদের পুজোসংখ্যার সম্পাদকীয় থেকে তুলে দেওয়া, পড়ুন:

"..মনে আজ শান্তি নেই, সে আনন্দও নেই।

কিছুদিন আগে অতি বর্ষণের ফলে পশ্চিমবাংলায় যে ভয়াবহ বন্যা হয়ে গেল, ব্যাপ্তি ও গভীরতায় তার বুঝি তুলনা নেই-অন্ততঃ স্মরণকালের ইতিহাসে তার নজির মিলবে কিনা সন্দেহ। এই বন্যার ফলে জেলার পর জেলায় সুবিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের ঘর ভেঙেছে, সংসার ভেসে গেছে, প্রাণহানি হয়েছে, স্থাবর-অস্থাবর সব সম্বল প্রায় ধ্বংস হয়েছে, গবাদি গৃহপালিত পশু ডুবে মরেছে আর মাঠের ও বাগানের ফসলের অর্থাৎ ধান ও শাক-সব্জির যে ক্ষতি হয়েছে তার পরিমাপ করা দুঃসাধ্য। এই লক্ষ লক্ষ সর্বস্বান্ত আর্ত ছাপোষা মানুষ আমাদেরই আপনজন। বিনা অপরাধে আজ তারা সর্বহারা। আমাদের আজ সবচেয়ে বড় কর্তব্য, অবিলম্বে তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো, সর্বশক্তি দিয়ে তাদের সাহায্য করা।

কিন্তু যে গুরুতর প্রশ্নটি আমাদের সবচেয়ে বেশী বিচলিত ও অস্থির করে তুলেছে, তা হলো- এর থেকে নিষ্কৃতি কোথায়? প্রতি বছর দেশের কোন-না-কোন অঞ্চলে একটু বেশী বৃষ্টি হলেই এই যে ভয়াবহ বন্যা নামছে, ধনপ্রাণ নষ্ট হচ্ছে বিপুল পরিমাণে, এটাকে কি আমরা বিধাতার রুদ্ররোষ ও অখণ্ডনীয় বিধিলিপি হিসাবে গ্রহণ করবো, না গ্রহণ করবো একদল মানুষের চরম অপদার্থতা, দুর্নীতি ও হৃদয়হীনতার ভয়ঙ্কর নিদর্শন হিসাবে?

এর উত্তর দেবার কথা দেশের সরকারের। কিন্তু আমাদের আশঙ্কা, তা দেবার মতো মনোবল তাদের বোধহয় নেই।

অত্যধিক বৃষ্টি হলে দেশের ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে এভাবে বিধ্বংসী বন্যা হবে কেন? দেশের অসংখ্য নদী-নালা-খাল যদি হেজে মজে ভরাট হয়ে না গিয়ে থাকে, তাদের খাত যদি গভীর থাকে এবং সুষ্ঠু স্রোত-চলাচলে যদি কোন বাধা না ঘটে, তাহলে যত বৃষ্টিই হোক, জল তো ঐ নদী-নালা-খাল দিয়ে বেরিয়ে যাবে। দেশের জল-নিষ্কাশনের এটাই তো স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ব্যবস্থা।

নদী-নালা-খাল ঠিকমতো চালু ও বহতা থাকলে, খরা-অনাবৃষ্টিতে যেমন জলের অভাবে ফসল না হবার ভয় থাকে না, তেমনি অতিরিক্ত বৃষ্টিতে ফসল ও ধনপ্রাণ নষ্ট হবারও আশঙ্কা থাকে না।

আমাদের দেহের রক্তবহা শিরা-উপশিরার মতো এগুলিই দেশের জলবহা শিরা-উপশিরা। দেহের শিরা-উপশিরায় রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত ঘটলে, যেমন গুরুতর রোগ ও শেষ পর্যন্ত মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী হবে দাঁড়ায়, তেমনি নদী-নালা-খাল যদি ঠিকমতো চালু না থাকে, তাহলে দেশের ক্রমাগত ক্ষয় ও শেষ পর্যন্ত ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে।

আমাদের দেশও আজ সেই ধ্বংসের দিকে অনিবার্য গতিতে এগিয়ে চলেছে। গুরুতর ক্ষয়রোগ ধরেছে তাকে অনেক দিন। কিন্তু কেন এই অবস্থা হলো, তার জবাব যাদের দেবার কথা, তারা কিন্তু নীরব।

দুনিয়ার প্রতিটি সভ্য অগ্রসর দেশের সরকার নিজের দেশের এই সব প্রকৃতিক শিরা-উপশিরা যাতে পুরোপুরি চালু ও বহতা থাকে, তার দিকে খরদৃষ্টি রাখেন। তাদের খাত যাতে ভরাট হয়ে না যায়, তার জন্য 'ড্রেজার' নামক অতিকায় যন্ত্র দিয়ে খাত থেকে মাটি কেটে তোলার নিয়মিত ব্যবস্থা করেন। উপরন্তু নতুন নতুন গভীর খাল কেটে তাঁরা দেশের শিরা-উপশিরার সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হন।

যে কোন প্রকৃত দায়িত্বশীল সরকারের পক্ষে এটাই স্বাভাবিক। আর এই স্বাভাবিক কাজ করার ফলে, অনাবৃষ্টি হোক আর অতিবৃষ্টি হোক, জলসেচ বা জলনিকাশের কোন দুর্ভাবনা থাকে না। পারমাণবিক যুগে মানুষ আজ যেখানে মহাবিশ্বের রহস্য উদ্‌ঘাটনের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে, সেখানে নদী-নালা-খালের এই গভীরতা ও স্রোত-চলাচল ঠিক রাখা তাদের কাছে কোন সমস্যাই নয়।

কিন্তু তা, মনে হয়, বিষম সমস্যা আমাদের দেশের সরকারের কাছে। কেন? তেইশ বছর পরে দেশের এই ভয়ঙ্কর সর্বনাশ ও বিপর্যয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্নটাই আমাদের মনকে বিদ্রোহী করে তুলেছে।

বন্ধু, আগামী দিনে এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করতে হবে তোমাদের, বাঁচাতে হবে আমাদের এই সোনার জন্মভূমিকে। তার জন্যেই আজ তৈরী হও তোমরা। তাহলেই সার্থক হবে কিশোর ভারতীর আত্মপ্রকাশ, তার এই দুর্গম পথ-পরিক্রমা আর ঐকান্তিক চেষ্টা, যত্ন ও পরিশ্রম।

***

( বলাই বাহুল্য, এমন মূল্যবান বইটা নির্দ্বিধায় সংগ্রহ করা যেতে পারে। এ'টা আমি অবশ্য উপহার পেয়েছি)।

No comments: