Wednesday, December 6, 2023

প্রফেসর হালদারের সমুদ্র-দর্শন



- প্রফেসর! প্রফেসর হালদার! এই যে!

- কী ব্যাপার সুমন, তুমি বেশ ফুর্তিতে আছ দেখছি? হুইচ ইজ ভেরি গুড৷ কিন্তু এমন একটা অপার্থিব সন্ধ্যের মধ্যে এমন চিৎকার-চ্যাঁচামেচি মেশানোর কী দরকার বলো দেখি!

- প্রফেসর! গভর্নমেন্ট আপনার অ্যাপ্লিকেশন এক্সেপ্ট করেছে৷ এই মাত্র মেসেজ এসেছে..।

- সমুদ্র জিনিসটা যে এত মিস্টিকাল, এ'টা এদ্দিন কেন বুঝিনি কে জানে।

- ল্যাবরেটরির বাইরে আপনাকে বড় একটা দেখতে পাই কই প্রফেসর। যাক গে, সে'সব থাক। এখন আবাউট দ্য গুড নিউজ..।

- ও মা! সে'সব থাক কেন? সে'সবই ভীষণ জরুরী৷ এই আমায় দ্যাখো। একটা বাষট্টি বছরের বুড়ো; তার কর্মস্থল থেকে পাঁচ-সাত মিনিটের হাঁটা পথে এমন সুন্দর ভান্টেজ পয়েন্ট, সে'খানে দাঁড়ালেই প্রাণভরে দেখা যায় এই নয়নাভিরাম দৃশ্য। একের পর এক ঢেউ, এমন মিস্টিকাল সন্ধ্যের আকাশ; আহা। অথচ এত বছরে একবারও আমার ইচ্ছে হয়নি এ'খানে এসে দাঁড়ানোর৷

- প্রফেসর! আপনার কী হয়েছে বলুন তো? বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ ল্যাবরেটরিতে থেকে বেরিয়ে গেলেন। আজ হঠাৎ এই সমুদ্র নিয়ে মুগ্ধ হয়ে পড়েছেন। ও'দিকে ল্যাবে গোটা টীম অধীর আগ্রহে বসে আপনার জন্য..।

- সুমন৷ এখুনি অন্ধকার হয়ে যাবে৷ ততক্ষণ বরং এসো, আমরা সমুদ্রের হাওয়া খাই৷ ফ্লাস্কে কফিও এনেছি, চলবে নাকি? 

- আমি একটা জরুরী এক্সপেরিমেন্ট ছেড়ে চলে এসেছি প্রফেসর, শুধু আপনাকে সুখবরটা দেব বলে। আপনি গতকাল যখন প্রপোজালটা পাঠালেন, কী ভীষণ উত্তেজিত ছিলেন আপনি৷ অথচ আজ একদম নির্লিপ্ত হয়ে..। প্রফেসর, আপনার শরীর ঠিকঠাক আছে তো?

- নেভার ফেল্ট বেটার। সুমন, আই নেভার ফেল্ট মোর অ্যালাইভ। কে বললে যে আমার প্রপোজালটা সরকার মেনে নিয়েছে? 

- চীফ সেক্রেটারি ফোন করেছিলেন সোজা ল্যাবে৷ আপনি না থাকায় আমার বললেন, "প্রফেসর হালদারকে জানিয়ে দিও, প্রাইম মিনিস্টার গ্রিন সিগনাল দিয়েছেন। অল দ্য বেস্ট"। ব্যাস, এ'টুকুই।

- নিশ্চিন্ত হওয়া গেল সুমন৷ এসো, পাশে বসো।

- আমি এখনই ল্যাবে না ফিরলে অবজার্ভেশনে এ'দিক ও'দিক হবে প্রফেসর। আপনি আমাদের প্রজেক্ট হেড, আপনি তো জানেন একটা রীডিং এ'দিক ও'দিক হওয়া মানে গোটা পৃথিবীর অনেকটা পিছিয়ে যাওয়া। 

- তোমার সমুদ্রকে অ্যাপ্রিশিয়েট না করতে পারা, এতে পৃথিবীর মঙ্গলসাধন হবে ভেবেছ? মনে রেখো; গত সতেরো বছরে আমাদের ল্যাব থেকে কোনও ব্রেকথ্রু বেরোয়নি।

- কিন্তু প্রগ্রেসও তো কম হয়নি। বাহাত্তরটা দেশ আমাদের এই ছোট্ট ল্যাবের দিকে উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে৷ আজ বা কাল ব্রেকথ্রু আসবেই।

- গভর্নমেন্টকে আমি কী প্রপোজাল পাঠিয়েছিলাম সে'টা বোধ হয় তোমায় জানানো হয়নি। 

- কাউকেই জানাননি। আমরা শুধু জানি যে আপনার প্রপোজাল মানে নিশ্চয়ই প্রজেক্টের জন্য একটা মেজর লীপ। কাজেই গভর্নমেন্টের গ্রীন সিগনাল আসা মাত্রই সবাই অপেক্ষায়, আপনি এসে ব্যাপারটা খোলসা করবেন বলে। এ'টা কি নতুন গ্রান্ট বিষয়ক কিছু?

- কফি? 

- থাক প্রফেসর।

- সুমন৷ আই ইনসিস্ট। ব্ল্যাক। চিন্তা নেই।

- থ্যাঙ্কিউ৷ 

- সুমন, কমরেড! আমার প্রপোজাল ছিল বিশ্বে প্রথম স্বেচ্ছামৃত্যর, যে'খানে কোনও রোগভোগ নেই। হতাশা নেই৷ এমন কি বৃদ্ধের অকেজো দেহের দায়ভারও নেই, আমি বেশ সুপারফিট এখনও৷ কিন্তু এই প্রথম কেউ চলে যেতে চাইছে কারণ "আর কত ভাইটি"। আমি চলে যেতে চাই কারম আমি তৃপ্ত।

- ক...কী?

- কফিটা বড্ড কড়া কি?

- প্রফেসর?

- বসো, দু'দণ্ড জিরিয়ে নাও। দ্যাখো, আলো এক্কেবারে নেমে গেছে, স্রেফ বেগুনী মায়া ছড়িয়ে আছে।

- আপনি কি পাগল হয়ে গেলেন?

- এত সাংঘাতিক একটা প্রপোজাল, ইউথানেসিয়া এমন একজনের যে এ যুগের সবচেয়ে বড় গ্লোবাল সাইন্টিফিক প্রজেক্টকে লীড করছে। কোনও রকম অসুস্থতা নেই, ডিপ্রেশন নেই। অথচ দেশের প্রধানমন্ত্রীও এক কথায় রাজী, আমার প্রপোজালটা এতটাই মজবুত ছিল৷ মানসিকভাবে প্রবলভাবে সুস্থ না হলে কি অমন প্রপোজাল ফাঁদা সম্ভব?

- আমার...আমার শরীর খারাপ লাগছে প্রফেসর..।

- এ প্রজেক্টের দায়িত্ব এ'বার তোমাকেই নিতে হবে সুমন। অত নরম হলে চলবে কেন?

- কিন্তু এমন হঠকারিতা কেন?

- সতেরো বছর এ প্রজেক্টে কাজ করলাম, নোবেল পেলাম। এমন কোনও সম্মান নেই যা আমার পকেটে নেই৷ আমি সত্যিই তৃপ্ত৷ কিন্তু প্রজেক্টকে এখনও শেষের দিকে ঠেলে দিতে পারিনি।

- কিন্তু আপনার  চেষ্টার তো কসুর নেই..।

- ঠিক৷ দিন-রাত এক করে কাজ করেছি। ল্যাবের বাইরে যে'টুকু বেরিয়েছি তা প্রজেক্টেরই কোনো কাজে। কী জানো সুমন, আজ আমি নিশ্চিত; দিনের কিছুটা সময় যদি এই মনকেমন করা সমুদ্রের সামনে এসে দাঁড়াতে পারতাম, তা'তে প্রজেক্টের উপকারই হত৷ এ দায়িত্ব এ'বার তুমিই বুঝে নেবে। এ'দিকে এসো মাঝেমধ্যে, কেমন?

- কিন্তু সে'টা তো এখন থেকে আপনিও করতে পারেন প্রফেসর..।

- সময়ের শেষ প্রান্তে এসে না দাঁড়ালে এ সমুদ্র আমি চিনতে পারতাম না সুমন। তুমি সে ভুল করবে না, এ'টুকু আশা নিয়ে আমি যাব৷ চলো এ'বার ফেরা যাক৷ সবাই অপেক্ষা করছে।

No comments: