Skip to main content

নারায়ণ দেবনাথ



আমি নিজের আগ্রহে প্রথম পড়া শুরু করি মূলত ছবি সর্বস্ব ছোটদের বইগুলো৷ দাদু উপহার দিত সে'সব বিভিন্ন বাহারে বই৷ আমার উপহার পাওয়া প্রথম বই যে'টা উল্টেপাল্টে গিলে খেয়েছিলাম, সে'টা হল একটা বাংলা ছড়া সংকলন। সে'খানে ছিল ছোটছোট প্রচলিত ছড়া, আর চমৎকার সব স্কেচ৷ আমার আগ্রহ ছিল ওই স্কেচগুলোর ওপর। বইটার নাম ছিল বোধ হয় 'ছোটদের ছড়া সঞ্চয়ন'। তার প্রথম পাতায় দাদু নীল কালিতে লিখে দিয়েছিল আমার পড়া প্রথম কবিতাঃ
"দাদু, আমার বড় ভালো,
ছড়াগুলো পড়ে ফেলো"৷ 
এর বাইরে ছিল দাদুরই দেওয়া রাদুগা প্রকাশনীর ইয়াব্বড় কিছু বই, পাতা জোড়া ঢাউস সব চমৎকার আঁকা আর অল্প কথা, সহজ শব্দে সাজানো সরল প্লটের মজাদার গল্প৷ এ'ছাড়া ওই ছবিতে রামায়ণ বা মহাভারত তো ছিলই৷ মোট কথা হল সে'সব ছবি গিলতে গিলতে কয়েক লাইন পড়ে ফেলতাম৷ ছবি উপভোগ করাটাই ছিল আমার আদত পড়া। পারতপক্ষে ছবিবিহীন গল্পওলা বইটইয়ের দিকে তেমন ঘেঁষতাম না৷ সত্যি কথা বলতে কি, সেই খুদে বয়সে কমিক্সের দিকেও তেমন ঝুঁকিনি৷ বাড়িতে রাখা বাংলা কাগজে তখন নিয়মিত স্পাইডারম্যান আর ফ্ল্যাশ গর্ডনের কমিক্স প্রকাশ হত৷ দাদুর দেওয়া ছবির বইগুলোর তুলনায় সেই কমিক্সগুলোকে আমার একটু জটিল বোধ হত৷ সে'সব কমিক্সে আমি মন দিয়ে শুধু ছবিগুলো দেখতাম, স্পীচ বাবলে কী লেখা আছে তা নিয়ে মাথা ঘামাতাম না। আমি খুঁজতাম সরল ভিসুয়াল প্লট, জলের মত ভাষা আর চমৎকার সহজবোধ্য অ্যাকশন। 

মনে আছে, যে কোনও পত্রিকাও তেমন টেনে দেখার আগ্রহ ছিল না সেই কচি বয়সে৷ পত্রিকা মানেই মনে হত কাটখোট্টা একটা ব্যাপার; বড্ড বেশি লেখা, ছবি কম৷ আমার এক দূরসম্পর্কের মামা তখন স্কুলেই পড়ে, তবে উঁচু ক্লাসে৷ তার বাড়িতে মাঝেমধ্যে যেতাম, তখন আমি খুব ছোট হলেও মামা সঙ্গে দিব্যি গল্প জমত। সেই মামার পড়ার টেবিলেই আমি প্রথম শুকতারা দেখি। অন্য কোনও সুবিধেজনক বই না পেয়ে বা খেলার সুযোগ না থাকায় শুকতারাটাই উল্টেপাল্টে দেখি৷ পত্রিকা হলেও সে'টাকে ঠেলে সরিয়ে দিইনি কারণ সে'টার প্রচ্ছদ উল্টেই দেখেছিলাম বাঁটুলকে৷ বাঁটুলের গল্পে হোঁচট খাওয়ার প্রশ্নই নেই৷ প্রাঞ্জল ভাষা৷ একটা শব্দও কঠিন নয়। যেন পাড়াতুতো কোনও পিসেমশাই পাশে বসিয়ে মুড়িচানাচুর চিবুতে চিবুতে, চোখ গোলগোল করে গল্প শোনাচ্ছেন৷ আর গল্পের রসিকতাগুলো এতই সোজাসাপটা যে পড়তে পড়তে দিব্যি হেসে গড়িয়ে পড়া যায়৷ সে'গল্পের চরিত্রগুলো যেমনি সাদাসিধে, তাদের মুখের ভাষাও তেমনি৷ আর থপাস, গ্লাব গ্লাব, ইয়াইকস, গেলুম, সাঁইইই-হুইইইই, দমাস, গালগ, গদাম-ঘ্যাঁক, গেছি রে, দমাস-দমাক; এমন হাজারো শব্দ মিলে কানের মধ্যে চমৎকার সব সিনেম্যাটিক এফেক্ট তৈরি হচ্ছে৷ তারপর খুঁজে পেলাম বাহাদুর বেড়াল আর হাঁদাভোঁদা। সেই একই ধরণের সব আলাভোলা চরিত্র, আর তাদের নিয়ে জমজমাট কয়েকটা পাতা৷ ব্যাস, নারায়ণ দেবনাথই একা হাতে আমায় প্রথম কোনও পত্রিকার দিকে টেনে নিয়ে গেছিলেন। সেই মামার পুরনো বইয়ের আলমারি ঘেঁটে সমস্ত পুরনো শুকতারা বের করে চড়াও হয়েছিলাম। শেষে আমাদের বাড়ির কাগজকাকুকে বলে দেওয়া হল শুকতারা দেওয়ার কথা৷ 

শুকতারা আসলেই আমি চটাপট বাঁটুল, হাঁদাভোঁদা আর বাহাদুর বেড়াল পড়ে ফেলতাম৷ এবং বারবার পড়তাম একই স্ট্রিপগুলো৷ নারায়ণ দেবনাথের ভাষার মাটিতে এলোপাথাড়ি গড়াগড়ি খেয়েই আমার ভালোবেসে বাংলা পড়া শুরু৷ এই প্রথম ছবির পাশাপাশি লেখার মায়া আমায় টেনে ধরল। পড়ার সাহস বাড়ল৷ কিছুদিনের স্রেফ নারায়ণ বাবুর কমিক্সে আটকে থাকার পর হুট করে এগিয়ে গেছিলাম অন্য কমিক্সে; 'বিলির বুট'। তদ্দিনে নারায়ণবাবু বাংলা পড়ার কনফিডেন্স সামান্য বাড়িয়ে দিয়েছেন, চিনিয়েছেন কমিক্সের অলিখিত সব নিয়মকানুন৷ এ'বার আর বিলির বুটের অসুবিধে হল না।

মজার ব্যাপার হল, বাঁটুল পড়তে পড়তে একদিন দুম করে 'দাদুমণির চিঠি' (শুকতারার সম্পাদকীয়) পড়তে শুরু করলাম৷ যদিও সে চিঠিতে ছবি নেই। কিন্তু বাঁটুল হাঁদাভোঁদা তদ্দিনে এন্তার পড়ে ফেলেছি৷ নারায়ণবাবুর গোয়েন্দা কৌশিক আবার একটু সিরিয়াস, বাঙালি বন্ড যে সে৷ সে'কমিক্সও দিব্যি পড়ে চলেছি৷ এরপর দেখলাম দাদুমণির চিঠিও তেমন জটিল নয়৷ আমি নিশ্চিত, নারায়ণবাবু সাহস দিয়েছিলেন বলেই সে চিঠি পড়ার চেষ্টা করেছিলাম৷ এরপর ধীরে ধীরে শুকতারার অন্যান্য গল্পে গিয়ে পড়লাম৷ ধারাবাহিক উপন্যাসের প্রতি আগ্রহ তৈরি হল৷ এলো শারদীয় শুকতারার চমক, দুয়ের বদলে চার পাতার বাঁটুল ও হাঁদাভোঁদা, একের বদলে দু'পাতার বাহাদুর বেড়াল৷ সে যেন এক কার্নিভাল৷ প্রথম শারদীয়া শুকতারা হাতে পেয়ে  সে'সব কমিক্স বোধ হয় শ'খানেকবার পড়ে ফেলেছিলাম৷ নারায়ণবাবু আমায় পড়িয়ে ছেড়েছেন৷ পড়ার নেশা ধরিয়ে ছেড়েছেন তদ্দিনে৷ তারপর যা হওয়ার তাই হল৷ সাহস করে পড়ে ফেলেছিলাম ফ্রান্সিসের অ্যাডভেঞ্চার। অন্যান্য গল্প উপন্যাস৷ খুঁজতে শুরু করেছিলাম অন্যান্য গল্পের বই৷ ধীরে ধীরে এলো শঙ্কর-আলভারেজ, ফেলুদা-তোপসে, কাকাবাবু, টেনিদা এবং আরও কত ভালোবাসার মানুষজন৷  

কাজেই নারায়ণ দেবনাথকে ছুঁয়েই আমার গল্পের বই পড়া শুরু,  বাংলা ভাষা তরতরিয়ে পড়তে পারার অনাবিল আনন্দটুকু চিনতে শেখা৷ আর আমি নিশ্চিত যে এ ব্যাপারে আমি একা নই৷

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু