Skip to main content

টিনটিন আর ক্লাস সেভেন



টিনটিনের গল্প যতবারই পড়তে বসি, ততবারই ক্লাস সেভেনের বয়সে চালান হয়ে পড়তে হয়। 

কাগজকাকুকে নিয়মিত বিরক্ত করতে হত পরের আনন্দমেলা কবে বেরোবে সে খবর আদায় করতে৷ কাকু উদভ্রান্ত হয়ে মাঝেমধ্যে বলতেন যে অত তাড়া লাগালে তো আর পত্রিকাটা কেউ সাততাড়াতাড়ি ছেপে দেবে না৷ আনন্দমেলার প্রতি সেই অমোঘ টানের মূলে ছিল টিনটিন৷ দু'পাতা করে সে কমিক্স প্রতি সংখ্যায় থাকত৷ আর ওই দু'পাতা যে কতবার পড়তাম তার হিসেব থাকত না৷ সেই দু'পাতা নিয়ে কতশত জরুরী আলোচনা চলত স্কুলে, বিকেলের খেলার মাঠে৷

মাঝেমধ্যে আনন্দমেলা চমকে দিত বিশেষ দু'সংখ্যায় পুরো কমিক্স শেষ করে৷ আমার সবচেয়ে প্রিয় টিনটনের কমিক্স 'চন্দ্রলোকে অভিযান' তেমন ভাবেই প্রকাশিত হয়েছিল মূল আনন্দমেলায়; সেই কমিক্সই তখন প্রচ্ছদে৷ এই অ্যাডভেঞ্চারের পরের অংশ "চাঁদে টিনটিন"ও সে ভাবেই প্রকাশিত হয়েছিল৷ আর চন্দ্রলোকে অভিযান পড়ার পর যদ্দিন না " চাঁদে টিনটিন" ছাপা হয়েছে; সে কী বিশ্রী অস্বস্তি, কী নিষ্ফলা ছটফট। আনন্দমেলার সেই সংখ্যাগুলো আগলে রাখতাম, আগলে রাখার মতই ছিল সে'গুলো। 

সমস্যা হল মূল কমিক্সের বইগুলোকে চিরকালই বড় দামী মনে হত৷ তুলনামূলক ভাবে বাঁটুল, হাঁদাভোঁদা বা অরণ্যদেব ছিল বেশ সুলভ৷ ইংরেজিগুলো ছেড়েই দিলাম, বাংলাগুলোও আওতার বাইরেই মনে হত। রেল স্টেশনের হুইলারে বা বড়সড় বইয়ের দোকানে সে বইগুলোর দিকে আমরা বন্ধুরা সোজাসুজি তাকানোরও চেষ্টা করতাম না বোধ হয়৷ অমন পেল্লায় সাইজ, অমন দুর্দান্ত মাখন-ছোঁয়ানো পাতার কোয়ালিটি, হাইক্লাস ঝকঝকে ছাপা; উফ্। ডায়মন্ড কমিক্সের অরণ্যদেবও সে জৌলুসের ধারেকাছেও পৌঁছতে পারত না৷ আর সে কারণেই আনন্দমেলার সেই বিশেষ টিনটিন সংখ্যাগুলো রীতিমতো অমূল্য ছিল। 

একসময় সেই খোকা চাকরী পেয়ে লায়েক হল৷ শখআহ্লাদে টু-পাইস ঢেলে তৃপ্তি পেতে শিখলে৷ অলিপাবের স্টেক এলো, হুশ করে ঘুরে আসার হিমাচল এলো, হুট-শখে কিনে ফেলা অমুক অমনিবাস বা তমুক সিরিজ৷ কিন্তু সহজে এলো না টিনটিনের কমিক্স কিনে ফেলার দুঃসাহস। কারণ লায়েকবাবুটি টিনটিনের সামনে চিরকালের ক্লাস সেভেন৷ টিনটিনের বই কেনা যায় না, খেটেখুটে আনন্দমেলার মাধ্যমে টিনটিন সংগ্রহ করতে হয়ে; এ কন্ডিশনিং কাটিয়ে ওঠা সহজ নয় বোধ হয়। 

বড় হওয়ার কতশত ধাপ৷ কত সম্পর্ক, কত শেখা, কত জ্বালাযন্ত্রণা, কত ভালোবাসা-মায়া, কত সুনিবিড় দুঃখ; এ সমস্ত স্পর্শ করে তবে বড় হওয়া, বুড়িয়ে যাওয়া। কিন্তু অ্যাডাল্টিংয়ের অন্যতম আর্মস্ট্রংয়িও পদক্ষেপ বোধ হয় টিনটিনের ইংরেজি বই কেনার সাহস জুটিয়ে উঠতে পারা৷ টিনটিন বক্স সেট অর্ডার দেওয়ার আগে কল্পনায় একটা ক্লাস সেভেনের খোকার হাত শক্ত করে ধরার দরকার পড়েছিল, 
"কিনে ফেলি? কী বলিস? কিনেই ফেলি! নাকি"?
একটা বড়সড় ঢোক গিলে মাথা নেড়েছিল কুমার ক্লাস-সেভেন। 

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু