Skip to main content

কলকাতার মেসিয়াহ্‌ - ৫


মেসবাড়ি থেকে কলেজ বাসে তিনটে স্টপেজ। সকাল এগারোটা থেকে ফার্স্ট ক্লাস। অরূপ অবশ্য হেঁটেই যায়।

হাঁটার জন্য কলকাতা অতি চমৎকার জায়গা। একটু আগেভাগে স্নান সেরে নিতে হয়। একটা বাথরুম, পনেরোটা মানুষ; একটু হুড়মুড় থাকেই। সব থেকে বেশি সময় লাগে অজয়দার, তবে অজয়দা কলেজটলেজ বিশেষ যায় না। সকলে বেরিয়ে গেলে তারপর স্নান সারে সে। অজয়দা বলে স্নান হল সাধনা; দুরাউন্ড সাবান, একটু টপ্পা আর দুদিনে একবার শ্যাম্পু না মিশলে স্নান জমে না। অরূপ একবার বোকার মত প্রশ্ন করে ফেলেছিল প্রতি স্নানে দুরাউন্ড সাবান? কিন্তু এই দুমাসে যে তোমায় একটাও নতুন সাবান আনতে দেখিনি। অজয়দা খুব চটে গেছিল গুরুজনকে সম্মান করতে পারিস না? ইডিয়ট! পালটা প্রশ্ন? মেসে অ্যানার্কি ঢোকাবার তাল করছিস”? রীতিমত ঘাবড়ে গেছিল অরূপ। অজয়দার টপ্পাপ্রীতি নিয়ে আর প্রশ্ন করা হয়ে ওঠেনি। অজয়দার রাগ অবশ্য বেশিক্ষণ টেকেনি কারণ ওর নিয়মিত জলখাবার হচ্ছে মেস লাগোয়া মন্টুদার দোকান থেকে আনা এক ভাঁড় চা, অরূপের বাড়ি থেকে নিয়মিত সাপ্লাই আসা মায়ের হাতে বানানো দুপিস গজা আর একটা গোল্ডফ্লেক। কাজেই অরূপের ওপর বেশিদিন রাগ করে থাকলে অজয়দাকে গজাNone হয়ে বসে থাকতে হবে। পাশের বেডের বল্টুদা ফিসফিসিয়ে বলেছিল অজয়দা বলে স্নান আর ধ্যান গোপনে করা উচিৎ। বল্টুদার বিশ্বাস আর দুচার বছর এগজ্যাম ড্রপ দিয়ে মেসে কাটিয়ে দিতে পারলেই অজয়দা পরমহংস হয়ে যাবে। তখন খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে অজয়দার জন্য এক পিস রাসমণি আর একটা বিবেকানন্দ খুঁজতে হবে।

যা হোক। শহরে ফুটপাথ ধরে হাঁটতে অরূপের বড় ভালো লাগে। মেসবাড়ি সরু গলি ধরে কিছুটা এগোলেই হ্যারিসন রোড। রাস্তার এক ধার দিয়ে ঠাসা নিমন্ত্রণ-পত্র ছাপানোর দোকান। অন্তত সতেরোটা দোকান তো হবেই। হ্যারিসন রোডটা যেখানে গিয়ে কলেজ স্ট্রিট মোড়ে মিশছে তার ঠিক কিছুটা আগেই দেলখোশা। অরূপ যখন দেলখোশা পেরোয় তখন রেস্টুরেন্ট সবে খুলব খুলব করছে, সাফসাফাই চলছে পুরো দমে। দেলখোশা অরূপের বেশ পছন্দ হয়েছে, সমস্ত কিছু কেমন সাত-পুরনো। কাউন্টারে বসা ম্যানেজার থেকে শুরু করে, ওয়েটার থেকে আসবাব, মেঝে, দেওয়াল সমস্ত কিছু। পুরনো। অরূপের স্থির বিশ্বাস ওই পুরনো গন্ধটা সরিয়ে নিলেই দেলখোশার কাটলেটের অর্ধেক হয়ে যাবে।

দেলখোশা থেকেই গিজগিজ করছে বইয়ের দোকান। চারিদিকে বই। বেশির ভাগ অবশ্য পড়ার বই। কিন্তু এত বইয়ের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে দিব্যি লাগে অরূপের। অদ্ভুত ব্যাপার, মাঝেমধ্যে অরূপ হাঁক শুনতে পায় কোনও না কোনও দোকান থেকে এইযে ভাই, দিকে! সব রকমের গাইড বই আছে। অরূপ বিরক্ত হয়, তাকে দেখে কি খুব গাইড বই গিলে বমি করা ছেলে মনে হয়? মাঝেমধ্যে পরীক্ষায় যে অরূপ ধেড়িয়ে বসে না তা নয়, তবু গাইডবইয়ের সামনে নতজানু হয়নি কোনওদিন। ছোটমামা বলে নম্বরটম্বর সব বাতেলা। নম্বরের জন্য ল্যাজ গুটিয়ে নেওয়ার কোনও মানে হয় না।

অরূপের মূল আগ্রহ টিফিনের দোকানগুলো নিয়ে। ক্যালক্যাটা ইউনিভার্সিটির সামনে খান দুই। মেডিকাল কলেজের সামনে খান তিনেক। টোস্ট, বাটার টোস্ট, ডিম টোস্ট, বাপুজি কেক, মামলেট, পোচ, ঘুগনি পাউরুটি, চা, চার থেকে ছরকমের বিস্কুট; কত কী। এই সবকিছু মেলানো সুবাসের মণ্ডটা বুকে সেধোতেই মনে হয় আহ্‌, আজকের দিনটা দিব্যি যাবে। রোজ, রোজ এমনটাই মনে হয়। মেডিকাল কলেজের উল্টোদিকে সারি সারি ওষুধ আর মেডিকাল সরঞ্জামের দোকান। এখান থেকে রঙটা পালটে যেতে আরম্ভ করে। খানিক পর থেকে একের পর এক বাথরুম ফিটিংসের দোকান। এর ফাঁকেই অবশ্য অরূপ দেখে নিয়েছে একটা ভালো কনফেকশনারির দোকান। বৌবাজার মোড়ের ঠিক আগে একটা মন্দির। তার পাশ দিয়ে একটা গলি ঢুকে গেছে যেটা অজয়দার ভাষায় আমার টপ্পাবোধ আর এই গলির হালহকিকত; এই দুই নিয়ে বিশেষ খোঁজখবর করতে যেও না হে অরূপকুমার, সে সত্য ধারণ করার ক্ষমতা তোমার মত সিলেবাস ঘাঁটা বান্দার নেই

কলেজে ঢোকার মুখে একটা টেলিফোন বুথ। অরূপ রোজ সকালে একটা ফোন করে মাকে। রোজ একই কথার সিরিজ। অরূপ খাবার খেয়েছে কিনা। জামাকাপড় সময়মত কাচছে কিনা। রোজ মশারি টাঙিয়ে শুচ্ছে কিনা। অরূপ মাঝেমধ্যে ভাবে জিজ্ঞেস করবে তাঁর নামে বাড়িতে কোনও চিঠি এসেছে কিনা। কিন্তু তার কোনও মানে হয় না।

স্নান, খাওয়া, শরীর, পড়াশুনোর খবর মাকে জানিয়ে ফোন নামিয়ে রাখে অরূপ। তারপর সোজা ক্লাসরুম।   

Comments

Anonymous said…
জানি খুব বাজে স্বভাব, তাও না বলে থাকতে পারলাম না... 'উচিত' বানান 'ৎ' দিয়ে নয়... আসলে উচিত শব্দটা দেখলেই আমার শঙ্খ ঘোষের একটা লাইন মাথায় ঘোরে... 'চিৎ হওয়া উচিত নয়'...

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু