Skip to main content

মোহনপ্রতাপের বিলাপ

বিয়ে আর যাই হোক পুরুষের হাতের মোয়া নয়, ব্যাপারটা আগে থাকতেই আঁচ করতে পেরেছিলেন মোহনপ্রতাপ। নিজের প্রিয় চৌকি ফেলে ডিভ্যান কেনার সময়ই তাঁর মনটা খচখচিয়ে উঠেছিল বটে। বিশাল খাটের পেটে ঢাউস তিনটে বাক্স। বিয়ের আগে নিজের পড়ার টেবিলের ড্রয়ারটাই এ জীবনে ভরতে না পেরে সে'টাকে মাঝেমধ্যে আশট্রে হিসেবে ব্যবহার করে ফেলতেন মোহনপ্রতাপ। স্টিলের আলমারি পেরিয়ে ডিভান ভরে ফেলতে এক প্লুটো-ভর্তি জিনিসপত্র কিনতে হবে; এই ভেবে বিয়ের আগের তিন রাতে আড়াই বাক্স সিগারেট আর ছয় বাক্স নিমকি শেষ করেছিলেন তিনি।

কিন্তু বিপদ যে কতটা বেপরোয়া গতিতে ধেয়ে আসতে পারে সে'টা মোহনপ্রতাপ টের পেলেন বিয়ের দু'দিন পর।  ফ্যানের রেগুলেটর কমানো বাড়ানো নিয়ে ঝগড়া করে ফুলশয্যার রাতটা কোনওক্রমে কাটিয়েই গায়ের সমস্ত বিরক্তি ঝেড়ে ফেলতে সকাল সকাল স্নান করতে ছুটলেন মোহনপ্রতাপ।

বাথরুমে ঢুকতেই মোহনপ্রতাপের মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। বাথরুমের র‍্যাকে প্রসাধনী বলতে এদ্দিন রাখা থাকত একটা নিম সাবান গোলাপি প্লাস্টিকের সাবানদানীতে, দাড়ি কামানোর জন্য একটা সস্তা শেভিং ক্রীম, ব্লেডের প্যাকেট, রেজার, ফটকিরি, টুথব্রাশ, কোলগেটের টিউব আর হারপিকের বড় ডিবে। নিজের বাথরুমের সেই আদি রূপকেই চণ্ডিমণ্ডপ জ্ঞানে চিনে এসেছেন মোহনপ্রতাপ।

কিন্তু সে'দিন যেন পৃথিবীটা ওলটপাল্ট হয়ে গুবলেট করে ফেলেছিল মোহনপ্রতাপের শান্ত দুনিয়াটুকু। যে চণ্ডিমণ্ডপের ছায়ায় দাঁড়িয়ে "গুরুদেব দয়া কর দীন জনে" গাইতেন মোহন, সে'খানে আজ একটা বিশ্রী যান্ত্রিক ল্যাবোরেটরি। র‍্যাক ময় বিভিন্ন রঙের শিশি বোতল, কোনওটা প্লাস্টিক কোনওটা কাঁচের; তাতে রংবেরঙের সমস্ত সলিউশন। মাথার ঝিমঝিমটা সয়ে আসতে ক্রমশ জিনিসপত্র জরীপ করতে শুরু করলেন মোহনপ্রতাপ।

শ্যাম্পু দুই বোতল, বিশ্রী কন্সেন্ট্রেশনের এক শিশি কন্ডিশনার, গা ধোয়ার সাবান, হাত ধোয়ার সাবান,  চার পাঁচ রকমের অদ্ভুত রংচঙে শিশি যার মধ্যে কী আছে তা চেটে খেলেও মোহনপ্রতাপ ধরতে পারবেন না, মুখ ধোয়ার সাবান, মুখে মাখার প্যাক, মুখে লাগানোর লোশন, মুখে লাগানোর জেল, মুখে লাগানোর স্ক্রাব, মুখে লাগানোর তেল (ক্রমশ শুভদৃষ্টির মুহূর্তটাকে কারাওকেতে গাওয়া কিশোরকণ্ঠীর গান বলে মনে হচ্ছিল) আর আরও অন্তত বত্রিশ রকমের ক্রীম বা লোশন।

গা-বমি ভাবটা পাশ কাটিয়ে মোহনপ্রতাপের মাথাটা দুর্দান্ত রাগে চিড়চিড় করে উঠলো অন্য একটা ভয়াবহ দৃশ্যে। তাঁর ভালোবাসার নিমসাবানের ড্যালাসহ সাবানদানীটাকে র‍্যাক থেকে উৎপাটিত করে রাখা হয়ে প্যানের লাগোয়া জেটস্প্রে আর মগের মধ্যিখানের মেঝেতে।

মোহনপ্রতাপ দিব্যিদৃষ্টিতে দেখতে পেলেন তার চরিত্রের মুকুটখানা এক তুঘলকি শাসকের আগ্রাসী গাঁট্টায় ধুলোয় লুটিয়েছে। নিজের ডিএনএর পায়েসে কেরোসিন মিশে যেতে দেখে শিউরে উঠলেন তিনি।

রাগে উন্মত্ত মোহনপ্রতাপ গীজার বন্ধ করে দুদ্দাড় করে বাইরে এসে আহত সিংহের মত হাঁকলেন:

"কে করেছে বাথরুমের এ দশা? কে"?

মোহনপ্রতাপের কণ্ঠের গমগম তখনও এ দেওয়ালের মাকালী হার্ডওয়্যারের ক্যালেন্ডারে গোঁত্তা খেয়ে অন্য দেওয়ালে রাখা ভেঙ্গসরকারের পোস্টারে ধাক্কা খেয়ে চলেছে; এমন সময় একরাশ শিউলি বাতাস  জুলাইয়ের খটখট অগ্রাহ্য করে ঘরে ভেসে এলো। সঙ্গে ছাপার শাড়ির বাপুজী কেকে কামড় দেওয়া মসমস।

"কী ব্যাপার, সাতসকালে এমন ষাঁড়ের মত চিৎকার কেন"?

"না মানে, ইয়ে, মানে...বাথরুমে..."।

"বাথরুমে কী"?

"বলছিলাম যে, আমার স্কিনটা এত ড্রাই টাইপের, কী ধরণের ফেসওয়াশ স্যুইটেবল হবে বলতে পারো গো"?

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু