Tuesday, December 15, 2015

অভিযান

কতদিন পর। কতগুলো দিন পর। গুনে গুনে ঠিক এক হাজার পাঁচশো বারো দিন পর। আবার সেই চেনা দুনিয়া। আবার আপন সমস্ত কিছু। চেনা চেনা গন্ধগুলো যেন নরম সুরে জাপটে ধরেছে; মাটি, পুরনো তাক, পরিচিত মানুষ, রাস্তা; কত ভালোবাসা মেদুর আমার দুনিয়াটা। আমার এই দুনিয়াটা। 

ঘোলাটে আকাশটা যেন ঠিক মায়ের মত।



মায়ের কথা মনে আসায় মনটা কেমন হয় গেল খানিক সময়ের জন্য। আসলে যাওয়ার দিনটাতেও মা ছিল। পাঁচ বছরের তফাতে এখন সমস্ত ফাঁকা। মায়ের ঘরের দিকে পা বাড়াতে সাহস হচ্ছে না। অথচ আজকের এই দিনটায় মার থাকার যে কী দরকার ছিল। মার সেই বেখাপ্পা ছেলেটা আজ দেশের একজন; দশের একজন। মা:, মাগো বলে ককিয়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল। 


আমার নিজের দুনিয়াটাকে বার বার ছুঁয়ে দেখে বিশ্বাস করতে হচ্ছিল।আমার বিছানা, আমার ল্যাবরেটরি, আমার ফেলে আসা দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিষপত্রগুলো; সমস্ত কিছু ছুঁয়ে, শুঁকে, নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখতে ইচ্ছে করছিল আমার। 


আমি সত্যিই ফিরে এসেছি? ফিরে আসতে পেরেছি? ভাবতেই শিউরে উঠতে হচ্ছ। কত লোকের কত চিন্তা ছিল। পাঁচ বছরের মহাকাশ যাত্রা। এবং দুরূহ লক্ষ্যগুলো। রসদ ঠিকমত থাকবে কী না, অক্সিজেনের পরিমাণে টান পড়বে কী না। এত খরচ করে এত বছর সাধ্যসাধনা করে এই ‘মিশন’য়ে ঝাঁপ দিয়েছিলাম আমরা; আমি আর আমার পাঁচ সঙ্গী। আমরা তিনজন ফিরতে পেরেছি। বাইশটা বিভিন্ন গ্রহ ঘুরে, হাজার হাজার অলোকবর্ষ পেরিয়ে, অমূল্য সব ভূতাত্ত্বিক নমুনা সংগ্রহ করে আমরা ফিরতে পেরেছি। বীরের সম্মান দিয়ে আমাদের বরণ করে নেওয়া হয়েছে। কারণ আমাদের ঐতিহাসিক এই যাত্রার পর আমাদের ইতিহাস বইবে অন্য খাতে। 


নিজের বাড়িটাকে অবশ্য এতদিন পর দেখতে পেয়েও একই রকম লাগছে। মনে হচ্ছে এই তো সেদিন সবে ছেড়ে গেলাম। অবচেতনে হয়তো রোজ আমি আমার এই প্রিয় বারান্দায় পায়চারি করেছি, হয়তো ছাদে উঠে গেছি ভোরে। আসলে দিনের পর দিন এক ঘেয়ে আকাশপথ যাত্রা ক্লান্তিকর। অবচেতনের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না, আর আমার অবচেতন জুড়ে তো শুধু আমি নিজের জগতটাই বয়ে বেড়িয়েছি পাঁচটি বছর। আর আমার জগতের অনেকটা জুড়ে শুধু মা ছিল। ছিল। আর নেই।


যাক। যে জন্য জার্নালে কয়েকটা কথা লিখে রাখা। 
দুনিয়া জুড়ে সবাই জানে যে আমি আর আমার মহাকাশচারী সঙ্গীরা মহাকাশের একটা কোণা চষে বাইশটা গ্রহ ঘুরে এসেছি। কিছুদিন আগেও এটা স্বপ্ন ছিল আমাদের জন্য। আজ সম্ভব হয়েছে; সম্ভব হয়েছে বিজ্ঞানের প্রতি জাতিগত ভাবে আমাদের আনুগত্যের জন্য।আমাদের ভবিষ্যতের উত্থান গতি পাল্টে যাবে। যাবেই। আমাদের ইতিহাস আজ থেকে দু’ভাগে বর্ণিত হবে, আমাদের মহাকাশ যাত্রার আগের ও পরের ইতিহাস। 


কিন্তু সবচেয়ে বড় সাফল্যটা দুনিয়া জানবে না। অন্তত এখুনি জানতে পারবে না। আমাদের সরকার অন্তত সেরকমই চায়। কারণ আমরা যা নিয়ে এসেছি, সেটা আগুন আবিষ্কারের চেয়েও হয়তো বড় ব্যাপার। 


বাইশটা গ্রহে আমাদের পদার্পণ ঘটেছে আমাদের পাঁচ বছরের অভিযানে। একুশটা গ্রহে আমাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ হতে চলেছে কাল। কিন্তু শেষ যে গ্রহে আমরা পদার্পণ করেছি, তার ব্যাপারে এখনই কিছু জনসমক্ষে বলা যাবে না। গভর্নমেন্টের বারণ। 

কিন্তু স্বল্প শব্দে সে দুরন্ত অভিজ্ঞতা জার্নালে লিখে রাখার বিশেষ দরকার। বিশেষ দরকার। বাবা বলতেন গভর্নমেন্টকে বিশ্বাস করতে নেই। 
তাই। লিখে রাখা। 

শেষ যে গ্রহে আমরা নেমেছিলাম, সে গ্রহ বাকি একুশটা গ্রহের থেকে বিশেষ ভাবে আলাদা। আলাদা কারণ একমাত্র সেই গ্রহে আমরা প্রাণের স্পর্শ দেখতে পেয়েছি। শুধু প্রাণ নয়। সভ্যতা। ঝকঝকে সভ্যতা। অভাবনীয় গতির এক সভ্যতা। আমারা যেখানে নেমেছিলাম, তার পাশেই একটা ঘর; অনেকটা আমদেরই দুনিয়ার আর চারটে ঘরের মতই। আমাদের মহাকাশযানটা আড়াল করে রেখে; পা টিপে টিপে সেই ঘরের গায়ের একটা জানালার পাশে গিয়ে নজরদারি করলাম; আমি নিজেই । গিয়ে যা দেখলাম তা রোমহর্ষক বললে কম বলা হবে। ঘরটার জিনিষপত্র দেখে বুঝে নিতে অসুবিধে হয়না যে সেটা আসলে একটা ল্যাবরেটরি। বিভিন্ন পাত্রে বিভিন্ন রঙের কেমিক্যাল রাখা; তরল, গুঁড়ো- সবরকমের। বিভিন্ন রকম পাত্র ঘরময় রাখা, যাতে করে নিশ্চয়ই সমস্ত এক্সপেরিমেন্ট হয়। বার্নার রয়েছে। এমনকি রয়েছে বিভিন্ন মৃত ছোট শ্রেণীর জানোয়ারের মৃতদেহ। বায়োকেমিক্যাল ল্যাবরেটরি সম্ভবত। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, ল্যাবরেটরি দেখেই আঁচ করতে পেরেছি যে এ ল্যাবরেটরি যাদের; তাদের দুনিয়াও আমাদের চেয়ে অনেক বেশি উন্নততর। সেই ল্যাবরেটরি জুড়ে এমন এক প্রাণ উজাড় করে দেওয়া সুবাস ছিল; আমার মনে হচ্ছিল যেন সেই সুবাসই আমায় মায়ায় বেঁধে রাখবে। সম্ভবত কোন বিশেষ কেমিক্যাল। আর বার্নারে একটা পাত্র বসিয়ে কোন এক উদ্ভট সলিউশন তৈরিতে মগ্ন যে; সে প্রায় আমাদেরই মত একজন প্রাণী। প্রাণীটি সলিউশন তৈরি করতে করতে ঘনঘন একটা কেতাবের দিকে তাকাচ্ছে। বুঝলাম সমস্ত ফর্মুলা রয়েছে সেই কেতাবেই। ওই কেতাব হস্তগত করতে পারলেই আমাদের ইতিহাস পাল্টে যেতে পারে; কেতাবের ভাষা অন্য হলেও সে ভাষা ভেদ করার প্রযুক্তি আমাদের বৈজ্ঞানিকদের নিশ্চয়ই আছে। অথচ আমার হাতে সময় ছিল খুব অল্প; মহাকাশ যান কিছুক্ষণের মধ্যের উড়ান নেবে; এমনটাই ঠিক হয়েছিল। 


এমন সময়, অকস্মাৎ এলো সেই সুবর্ণ সুযোগ। ভিনগ্রহের যে প্রাণীটি সলিউশন তৈরিতে মগ্ন ছিল, সে আচমকা হাতের কেতাবটা জানালার কাছেই রেখে দিয়ে ঘরে বাইরে যাওয়ার জন্য পিছন ফিরলো। বার্নারে সলিউশন তখন টগবগিয়ে ফুটছে। আমি ঝপাৎ করে কেতাবটা হস্তগত করলাম; প্রাণের ঝুঁকি নিতে হয়েছিল আর কী। ভাগ্যিস প্রাণীটি সেদিকে খেয়াল না করে ঘরের বাইরে চলে গেল; আর সেই সময়ই দেখতে পেলাম; প্রাণীটা অনেকটা আমাদের মত হলেও –ওর পিছনে কোন ল্যাজ নেই। 



*** 
- বিশ্বাস কর গিন্নী, রেসিপির বইটা রেখে আমি জাস্ট এক মিনিটের জন্য বাইরে গেছিলাম জল খাব বলে। এসে দেখি বইটা হাওয়া। 
- হ্যাঁ, বইটার পাখনা গজিয়েছিল কী না, তাই সে জানালা দিয়ে ফুড়ুৎ করে উড়ে পালিয়েছে। 
- মাইরি বলছি, বিশ্বাস কর এইখানে রেখেছিলাম।
- থাম। খুব হয়েছে। রান্নায় ফাঁকি দেওয়ার জন্যে অমন সুন্দর বেলা দে’র রেসিপির বইটা ইচ্ছে করে হারিয়ে দিলে গো? 

1 comment:

Anonymous said...

darun darun :)