Skip to main content

বুলডোজার রাখাল আর মায়ের হারমোনিয়াম



১। 

- মিনিস্টার! একটা খবর ছিল..।

- দিস ইজ আনপার্ডনেবল চীফ।

- দেখুন মিনিস্টার, আমি যে কী বলব..।

- আপনাদের লজ্জা করে না? এত বড় একটা স্ক্যান্ডাল, এত বড় একটা সিকিউরিটি থ্রেট তৈরি হয়েছে স্রেফ আপনাদের ক্যাবলাকান্ত সিস্টেমের জন্য৷ আর এখন আপনি ভেবে পাচ্ছেন না যে কী বলবেন?

- আসলে গোটা ব্যাপারটাই এত মিস্টিরিয়াস..।

- তবে আর কী! দেশ গোল্লায় যাক। আর আপনারা, সেনাবাহিনীর কর্তারা; ব্যাপারটাকে মিস্টিরিয়াস বলে ঝাড়া-হাত-পা হয়ে ফুর্তি করুন। 

- দেখুন স্যার..। ব্যাপারটা সত্যিই ব্ল্যাক ম্যাজিকের মত..। 

- মাই ডিয়ার আর্মি চীফ গোবর্ধন গলুই৷ আমাদের ন্যাশনাল আর্মির গর্ব, আপনাদের দ্য গ্রেট বুলডোজার রেজিমেন্টের সমস্ত বুলডোজার কোনও রকম হিউম্যান ইন্টারভেনশন ছাড়া, নিজেরাই ব্যারাক থেকে বেরিয়ে পড়েছে৷ শহর জুড়ে হাহাকার..অথচ আপনারা ক্লুলেস?

- দেখুন মিনিস্টার, এই বুলডোজারগুলো অত্যাধুনিক৷ আপনি তো জানেন, গতবছরই এ'রকম বারোশো ইউনিট কেনা হল৷ সেল্ফ ড্রিভেন, রিমোট কন্ট্রোলড৷ কিন্তু তাই বলে তাদের তো আর নিজস্ব মগজ নেই৷ আমাদের কন্ট্রোলরুম থেকে হিউম্যান ইন্সট্রাকশন না গেলে তাদের এক ইঞ্চিও নড়ার কথা নয়।

- বেশ৷ তাই যদি হবে তা'হলে কন্ট্রোল রুমের হুকুম ছাড়া সে বুলডোজারের দল ব্যারাক ছেড়ে বেরোল কী করে?

- সে'টাই তো..ইয়ে..মিস্ট্রি৷ 

- নিনকম্পুপ্স! অত সাধের সব ইম্পোর্টেড বুলডোজার, যা না-পসন্দ তা নিমেষে সাফ; সে'গুলো শেষে হাতছাড়া হল? আরে ও'গুলোর তো এখনও ওয়ারেন্টিই খতম হয়নি৷ আপনাদের কোর্ট মার্শাল হওয়া উচিৎ! যাকগে, সে'সব সময়মত হবে'খন৷ আগে বলুন সেই গোলমেলে বুলডোজারগুলো এখন কোথায়? ওদের মুভমেন্ট ট্র‍্যাক করছেন আশা করি! সে ব্যাটারা কি নিজে নিজেই বস্তিটস্তি ভাঙা শুরু করল নাকি? অবশ্য ক্ষতি নেই তা'তে, কিন্তু মিডিয়াকে ডাকা হলো না যে৷ কভারেজ কম হবে। কেসটা কী?

- সে'টা রিপোর্ট করতেই এ'খানে এসেছি মিনিস্টার৷ 

- চটপট৷ নাটুকে সাইলেন্স আর সহ্য হচ্ছে না।

- সমস্ত বুলডোজার সারিবদ্ধ ভাবে, বেশ ডিসিপ্লিন নিয়ে এগোচ্ছে৷ কোনও বস্তি-টস্তির ধারেকাছে যায়নি।

- সে'কী! কোন দিকে এগোচ্ছে?

- ইয়ে..!

- চীফ গলুই, বুলডোজারগুলো কোনদিকে যাচ্ছে?

- যাচ্ছে না৷ মানে, ইয়ে৷ আসছে৷ 

- আসছে?

- এই এ'দিকে৷ জিপিএস তাই বলছে। 

- আ..আমাদের পার্টি আপিসের দিকে এগিয়ে আসছে?

- ই..ইয়ে..আসছে। 

- থামাও!

- কী বলি মিনিস্টার, থামছে কই! ইয়ে, একটা এমার্জেন্সি কল এসেছে মোবাইলে। 

- ফোনটা রিসিভ করে আমায় উদ্ধার করুন৷ দেখুন আর কী দুঃসংবাদ এলো৷

(মিনিট সাতেক পরে)

- মিনিস্টার! একটা ভাইটাল খবর। 

- কী?

- ব্যাপারটা খুব ইয়ে..ঠিক বিশ্বাসযোগ্য কিনা জানিনা৷ তবে আপনাদের এই পার্টি অফিসের বাইরে এক আধপাগলা লোক দাঁড়িয়ে হল্লা পাকাচ্ছিল। সে ক্লেম করেছে যে..।

- কী ক্লেম করছে?

- যে..যে সেই নাকি বুলডোজারদের ডেকে আনছে।

- হ্যামলিনের বুলডোজারওলা? ইয়ার্কি হচ্ছে?

- গোটা ব্যাপারটা এমনই ডার্ক আর গোলমেলে। কিছুই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। আমার কম্যান্ডাররা ওকে  থার্ড ডিগ্রী দিচ্ছে, কিন্তু সে ব্যাটার হাসি থামানো যাচ্ছে না। 

- ওকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন৷ 

- কিন্তু মিনিস্টার..।

- ক্যুইক৷

***

২।

- পেন্নাম অনারেবল মিনিস্টার হলধর হসন্ত! হোয়াট অ্যান অনার!

- আপনাকে ওরা খুব মারধোর করেছে বুঝি? আই অ্যাম সরি৷ আমি কিন্তু জানতে পেরেই..।

- ও নিয়ে আপনি ভাববেন না স্যার৷ আমি এ দেশের গরীবমানুষ, জীবনটাই থার্ডডিগ্রী৷ ও'সব চিমটি কাটায় আমাদের কিছু এসে যায়না।

- আপনার নাম?

- গোবিন্দ গাইয়ে। 

- বাহ্, সুন্দর নাম৷ তা, গোবিন্দবাবু, চা খাবেন? বা লেবুর সরবত? কোল্ডড্রিঙ্কস? লস্যি?

- ইয়ে, ভাত হবে? 

- ভাত?

- ভাত৷ 

- নিশ্চয়ই৷ এখুনি আনতে বলে দিচ্ছি৷ আমাদের ক্যান্টিনের থালি খুবই ফেমাস৷ সতেরো রকম আইটেম থাকে৷ ম্যাসিভ একজোড়া রাজভোগসহ। 

- এক্সেলেন্ট৷ আটশো বিরানব্বুই প্লেট অর্ডার করে দিন প্লীজ৷

- আটশো বিরানব্বুইটা প্লেট?

- আজ্ঞে। একটা এ'খানে দিয়ে যাবে৷ আর আটশো একানব্বইটা ডেলিভার করবে বোসপাড়ার পিছনের বস্তিতে৷ গতকাল আপনাদের বুলডোজারগুলো সে'খানকার লোকজনদের বাড়িঘরদোর ভেঙেটেঙে দিল। কাজেই তাদের আজ রান্নাবান্নার পাট নেই৷ আপনার লোক যদি খাবার ডেলিভার করে দেয়, তা'হলে রাতটা নিশ্চিন্ত৷ 

- গোবিন্দবাবু, কাজের কথায় আসি..। বুলডোজার।

- ভাতটা বোধ হয় তেমন কাজের কথা নয়, তাই না?

-  শুনুন৷ আপনি আর্মির লোককে বলেছেন যে ওই বুলডোজারগুলোকে আপনি ডেকে এনেছেন?

- সর্বৈব সত্য৷ হসন্তবাবু, বুলডোজার তো যন্ত্র৷ মানুষের ডাক না পেলে তারা নড়বে কী করে?

- অতগুলো বুলডোজার আপনার ডাকে সাড়া দিলে? এ'টা গুল নয়?

- গুল হলে, আপনি কি আমার ডেকে ভাত খাওয়াতেন?

- বুলডোজারগুলো আপনার ডাকে সাড়া দিচ্ছে? কেন?

- গতকাল আপনাদের বুলডোজার রেজিমেন্ট আমাদের পাড়ায় এলো বুঝলেন। হুলোর বাড়ি ভাঙলো সবার আগে। আমি পাত্তা না দিয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে পল্লীগীতি গাইছিলাম। তারপর মিনুর বাড়ি মাটির সঙ্গে মিশে গেল। আমি ধরলাম নজরুল। একে একে মধু, সেলিম, গুপে আর আরও কত মানুষের ঘর ভাঙল। বিশ্বাস করুন, আমি সে'সব ছোটখাটো ব্যাপারে পাত্তা না দিয়ে আমার হারমোনিয়াম নিয়ে দিব্যি ছিলাম। এমন কী আমার ঘরও যখন ভাঙতে এলো, আমি দিব্যি 'এক্সকিউজ মি' বলে পাশ কাটিয়ে, হারমোনিয়াম গলায় ঝুলিয়ে; বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে আমি গজল ধরেছি৷ আহা, সে কী প্রেম প্রেম ভাব৷ 

- তারপর?

- আমার গান আপনার বুলডোজার রেজিমেন্টের কম্যান্ডারদের সহ্য হল না৷ কোনও মানে হয় বলুন? তাঁরা স্রেফ হাহাকার শুনতে চায়, তাঁদের কানে গান সইল না। আমার হারমোনিয়াম ছিনিয়ে নিয়ে চলন্ত বুলডোজারের সামনে ফেলে দিলে৷ ব্যাস, সাফ৷ আমার বারণ শুনলে না। তারপর তাঁরা আমায় বেধড়ক পেটালে, বুঝলেন৷ এক্কেবারে তলপেটে ভারী বুটের লাথি৷ দে দমাদম৷ অজ্ঞান হয়ে গেলাম৷ জ্ঞান ফিরল এক্কেবারে ভোরের দিকে৷ সামনে আমার মায়ের রেখে যাওয়া হারমোনিয়াম গুঁড়ো হয়ে পড়ে৷ কিন্তু কী অদ্ভুত, গায়ে বিন্দুমাত্র ব্যথা নেই৷ আর..আর আমি দিব্যি টের পেলাম আমার মায়ের হারমোনিয়াম ভেঙে টুকরো টুকরো হওয়ার আগে আমার মধ্যে ম্যাজিক ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে।

- ম্যাজিক?

- আমি অনুভব করতে পারলাম হলধরবাবু৷ টেস্ট করার জন্য মনে মনে একটা বুলডোজারকে ডাকলাম৷ ও মা, পাক্কা দশ মিনিটের মধ্যে একটা বুলডোজার আমার সামনে এসে দাঁড়ালো, সে'টার মধ্যে থেকে একটা মিঠে যান্ত্রিক গোঙরগো শব্দ বেরোচ্ছে৷ ঠিক যেন একটা পোষা ভেড়া৷ ব্যাস, বাকি বুলডোজারদের ডেকে নিলাম। আর এখন তাদের চরিয়ে বেড়াচ্ছি৷ মিউজিশিয়ান থেকে রাখাল হয়ে গেলাম স্যার। 

- গোবিন্দবাবু! বুলডোজারদের আটকাতেই হবে!

- তারা রক্তের স্বাদ পেয়েছে মিনিস্টার হসন্ত৷ আর হারমোনিয়াম হত্যার পাপ তাদের হিংস্র করে তুলেছে৷ এ'বার নিস্তার নেই৷ 

- প্লীজ, শুনুন আপনি..।

- ওই যে, মন্টুসোনার গোঙরগো আওয়াজ পাচ্ছি। আপনি শুনতে পাচ্ছেন মিনিস্টার?

- মন্টুসোনা? মন্টুসোনা কে?

- ওই প্রথম যে বুলডোজার আমার কাছে এসে নত হয়েছিল৷ বড় আদর করে নাম রেখেছি৷ তা, সে এসে পৌঁছেছে আপনার অফিসে৷ যাকগে, একটা গজল শুনবেন হলধর হসন্ত?

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু