Sunday, June 19, 2022

চালশে আর ফার্স্টইয়ারি



সুমনবাবুর চালশে গানটা প্রথম শুনেছি কৈশোরে৷ আমার অন্যতম প্রিয় 'সুমনের গান'। আজও এ গানটা আমার কৈশোরের গান। কলেজের গান৷ হাইস্কুলে থাকতে বাড়ির ফিলিপ্স টেপরেকর্ডারে এ গান বাজত। পরে কলকাতার মেসে বসে সস্তায় কেনা এফএম রেডিওতে সে গান মাঝেমধ্যেই শোনা যেত৷ সে বয়সে, গানটা গুনগুন শুরু করলেই আশেপাশের চালশেদের প্রতি অস্ফুট "আহা, উঁহু"-ভাব টের পেতাম৷ একটা প্রবল সিমপ্যাথি। 

মনে হত, "আহা রে, কত গুঁতোগাঁতা খেয়ে এ বয়সে এসে পৌঁছেছেন৷ মাঝবয়সী খিটমিটগুলোয় না জানি তাদের কতশত স্ট্রাগল আড়াল হয়ে যাচ্ছে"।  ফার্স্টইয়ারি মেজাজের সিংহাসনে বসে ভাবতাম, "আফটার অল, এই বাবা-জ্যাঠা-কাকা-মামাদের তো ইয়ুথটাই গন৷ লোহা চিবিয়ে হজম করার দম আর নেই৷ বেনিয়মে বন্ধুদের হুল্লোড় নেই। সোমবার বিকেলের কলেজ স্কোয়্যারের ঘটিগরম নেই৷ প্রেমের চিঠি নিয়ে ফলাও করে মেস-বৈঠক বসানোর সুযোগ নেই৷ বাজে গল্পে রাতকাবার করার ধক নেই৷ পুজোয় লম্বা ছুটি নেই৷ এদের আর আছেটা কী। আহা রে, এ'দের জীবনটাই তো ফিনিশ হয়ে গেছে৷ পড়ে আছে শুধু গাদাগুচ্ছের রেস্পন্সিবিলিটি"। ব্যাস, এইসব ভাবনাকে আরও একটু উস্কে দিত সুমনের এই গান৷

এ'বারে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল, আজও এই গানটা আমি সেই ফার্সইয়ারি ছেলেবেলার কান ছাড়া শুনতে পারিনা৷ এমন অনেক গানই রয়েছে অবশ্য, যে'গুলো শিল্পী, সুর, কথার ওপরে গিয়ে স্মৃতি-ফসিল হয়ে রয়ে গেছে৷ কে সুমন, কীসের দামী লিরিক্স, কীসেরই বা মনকেমনের সুর- চালশের গানে সেই ক্লাস টুয়েলভ বা কলেজের বিকেল-রাত্রির গন্ধ লেগে৷ সেই গন্ধই সে গানের আইডেন্টিটি। এ'সব গান একটু মন দিয়ে শুনলে এখনও ক্যালকুলাসের ভয়টা বুকের মধ্যে ছ্যাঁতছ্যাঁতিয়ে উঠবে বোধ হয়৷ যাক গে, এই চালশের গান শুনলে এখনও ওই ফার্স্টইয়ারি একটা কণ্ঠস্বর ভারী মিহি স্বরে আহা উঁহু করে বলে, "আহা রে, যাদের বয়স চল্লিশ পেরোল তাদের কী দুঃখ গো৷ প্রভিডেন্ট ফান্ড নিয়ে চিন্তা করেই দিন গুজরান করতে হয়, কলেজ ফেস্টের খোঁজখবর আর তাদের নিরেট জীবনে দাগ কাটে না৷ জোড়া রোল খাওয়ার বদলে তারা একটা ভেজিটেবল চপ ইন্সটলমেন্টে খায়৷ ইশ৷ আর এরা বেপরোয়া বিরিয়ানিতে রইল না, সুবোধ স্যান্ডুইচে এসে ঠেকেছে৷ দলবেঁধে দীঘা যাবে কী, গ্রুপ ইন্সুরেন্স ছাড়া আর কোনও ভাবনায় এদের স্বস্তি নেই৷  এদের জন্য কী মনকেমন গো"। 

সমস্যা হল, সে সিমপ্যাথির বেলুনে সুট করে চুপসে দেয় অন্য একটা গাম্বাট কণ্ঠস্বর, " ওরে আমার কচি খোকা এলেন হে৷ এ'সব ভাবনা হাউই নিয়ে পড়ে থাকলে হবে? অম্বলের ওষুধ কি তোমার গ্র‍্যান্ডফাদার খাবে"? অমনি, বুকের মধ্যে বরফঝড়।   এই গান যে আর 'ওদের' জন্য লেখা নয়। এ গান এখন ডাইরেক্ট আমার এবং আমাদের৷ আমি আর এ গানের অডিয়েন্স নই, সাবজেক্ট৷ আমি আর "আজকে যে.."র দলে নেই৷ সুট করে "কালকে সে.." টীমে এসে দু'দণ্ড জিরিয়ে নিচ্ছি৷ চল্লিশ আসছে, ছোটবেলার সুমন দিয়ে তাকে ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না কিছুতেই৷

No comments: