Skip to main content

চালশে আর ফার্স্টইয়ারি



সুমনবাবুর চালশে গানটা প্রথম শুনেছি কৈশোরে৷ আমার অন্যতম প্রিয় 'সুমনের গান'। আজও এ গানটা আমার কৈশোরের গান। কলেজের গান৷ হাইস্কুলে থাকতে বাড়ির ফিলিপ্স টেপরেকর্ডারে এ গান বাজত। পরে কলকাতার মেসে বসে সস্তায় কেনা এফএম রেডিওতে সে গান মাঝেমধ্যেই শোনা যেত৷ সে বয়সে, গানটা গুনগুন শুরু করলেই আশেপাশের চালশেদের প্রতি অস্ফুট "আহা, উঁহু"-ভাব টের পেতাম৷ একটা প্রবল সিমপ্যাথি। 

মনে হত, "আহা রে, কত গুঁতোগাঁতা খেয়ে এ বয়সে এসে পৌঁছেছেন৷ মাঝবয়সী খিটমিটগুলোয় না জানি তাদের কতশত স্ট্রাগল আড়াল হয়ে যাচ্ছে"।  ফার্স্টইয়ারি মেজাজের সিংহাসনে বসে ভাবতাম, "আফটার অল, এই বাবা-জ্যাঠা-কাকা-মামাদের তো ইয়ুথটাই গন৷ লোহা চিবিয়ে হজম করার দম আর নেই৷ বেনিয়মে বন্ধুদের হুল্লোড় নেই। সোমবার বিকেলের কলেজ স্কোয়্যারের ঘটিগরম নেই৷ প্রেমের চিঠি নিয়ে ফলাও করে মেস-বৈঠক বসানোর সুযোগ নেই৷ বাজে গল্পে রাতকাবার করার ধক নেই৷ পুজোয় লম্বা ছুটি নেই৷ এদের আর আছেটা কী। আহা রে, এ'দের জীবনটাই তো ফিনিশ হয়ে গেছে৷ পড়ে আছে শুধু গাদাগুচ্ছের রেস্পন্সিবিলিটি"। ব্যাস, এইসব ভাবনাকে আরও একটু উস্কে দিত সুমনের এই গান৷

এ'বারে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল, আজও এই গানটা আমি সেই ফার্সইয়ারি ছেলেবেলার কান ছাড়া শুনতে পারিনা৷ এমন অনেক গানই রয়েছে অবশ্য, যে'গুলো শিল্পী, সুর, কথার ওপরে গিয়ে স্মৃতি-ফসিল হয়ে রয়ে গেছে৷ কে সুমন, কীসের দামী লিরিক্স, কীসেরই বা মনকেমনের সুর- চালশের গানে সেই ক্লাস টুয়েলভ বা কলেজের বিকেল-রাত্রির গন্ধ লেগে৷ সেই গন্ধই সে গানের আইডেন্টিটি। এ'সব গান একটু মন দিয়ে শুনলে এখনও ক্যালকুলাসের ভয়টা বুকের মধ্যে ছ্যাঁতছ্যাঁতিয়ে উঠবে বোধ হয়৷ যাক গে, এই চালশের গান শুনলে এখনও ওই ফার্স্টইয়ারি একটা কণ্ঠস্বর ভারী মিহি স্বরে আহা উঁহু করে বলে, "আহা রে, যাদের বয়স চল্লিশ পেরোল তাদের কী দুঃখ গো৷ প্রভিডেন্ট ফান্ড নিয়ে চিন্তা করেই দিন গুজরান করতে হয়, কলেজ ফেস্টের খোঁজখবর আর তাদের নিরেট জীবনে দাগ কাটে না৷ জোড়া রোল খাওয়ার বদলে তারা একটা ভেজিটেবল চপ ইন্সটলমেন্টে খায়৷ ইশ৷ আর এরা বেপরোয়া বিরিয়ানিতে রইল না, সুবোধ স্যান্ডুইচে এসে ঠেকেছে৷ দলবেঁধে দীঘা যাবে কী, গ্রুপ ইন্সুরেন্স ছাড়া আর কোনও ভাবনায় এদের স্বস্তি নেই৷  এদের জন্য কী মনকেমন গো"। 

সমস্যা হল, সে সিমপ্যাথির বেলুনে সুট করে চুপসে দেয় অন্য একটা গাম্বাট কণ্ঠস্বর, " ওরে আমার কচি খোকা এলেন হে৷ এ'সব ভাবনা হাউই নিয়ে পড়ে থাকলে হবে? অম্বলের ওষুধ কি তোমার গ্র‍্যান্ডফাদার খাবে"? অমনি, বুকের মধ্যে বরফঝড়।   এই গান যে আর 'ওদের' জন্য লেখা নয়। এ গান এখন ডাইরেক্ট আমার এবং আমাদের৷ আমি আর এ গানের অডিয়েন্স নই, সাবজেক্ট৷ আমি আর "আজকে যে.."র দলে নেই৷ সুট করে "কালকে সে.." টীমে এসে দু'দণ্ড জিরিয়ে নিচ্ছি৷ চল্লিশ আসছে, ছোটবেলার সুমন দিয়ে তাকে ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না কিছুতেই৷

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

ব্লগ-বাজ

আর চিন্তা নেই । বাঙালিকে আর রোখা যাবে না । আর সামান্য (সম্ভবত কিঞ্চিত গোলমেলে ) কবিতা ছাপাবার জন্যে সম্পাদক কে তোল্লাই দিতে হবে না । আর প্রেমে লটরপটর হয়ে ডায়েরি লিখে প্রাণপাত করতে হবে না। পলিটিক্স কে পাবলিক-জন্ডিস বলে গাল দেওয়ার জন্য আর “প্রিয় সম্পাদক” বলে আনন্দবাজারের ঠ্যাং ধরতে হবে না। কেন ?  হোয়াই? বাঙালি ব্লগিং শিখে গ্যাছে যে। ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে শাণিত তলোয়ারের মত “ পোস্ট”-সমূহ জনতার ইন্টেলেক্ট এসপার-ওসপার করে দেবে ; হাতে-গরম গায়ে-কাঁটা। বাঙালি মননের নব্য জিস্পট ; ব্লগ-স্পট । কে বলে যে বাঙালি ব্রিগেডে বুক্তুনি দিয়ে আর ফুটবল মাঠে খেউড় করে খতম হয়ে গ্যাছে ? কে বলে যে বাঙালির ঘিলু কফি হাউসে ভাত ঘুমে মগ্ন ? বাঙালিকে একবার ব্লগখোর হতে দিন , সমস্ত অভিযোগ ভ্যানিশ হয়ে যাবে । পোপ থেকে পরশুরাম ; ডেঙ্গু থেকে মশাগ্রাম ; বং-ব্লগের দাপট রইবে সর্বত্র । বাঙালির সমস্ত আশা-ভরসা-জিজ্ঞাসা এইবারে ব্লগ মারফত্‍ পৌছে যাবে ট্যাংরা ট্যু টেক্সাস । তোপসে মাছের স্প্যানিশ ঝোলের রেসিপি কী ? বাঙাল-ঘটি মিল মহব্বত-হয়ে গেলে কি বাঙ্গালিয়ানা চটকে যাবে ? নেতাজী কি এখ

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু