Tuesday, August 23, 2022

অর্ক আর সুমন



স্কুল থেকে ফিরেই দুদ্দাড় করে স্নান, হুশহাশ করে ঝোল-ভাত সাফ করা। এর পর অর্ক গিয়ে বসে ছাতের ঘরে। এ'টাই তার দুপুর-সাম্রাজ্য। আর তার সাম্রাজ্যে সবচেয়ে দামী জিনিস হল একটা ফিলিপ্সের পুরনো টেপরেকর্ডার।  মেজদা এক জন্মদিনে উপহার পেয়েছিল, কলকাতার কলেজে পড়তে যাওয়ার আগে অর্ককে উইল করে দিয়ে গেছে। 

তা'তে প্রচুর হিন্দি গান শোনে অর্ক। প্রচুর। কুমার শানু, উদিত নারায়ণ, অলকা ইয়াগ্নিক আর সাধনা সরগম; তার খুব পছন্দ। ফুলকাকার ধারণা অত লারেলাপ্পা হিন্দি গান শুনে অর্ক বখে যাবে। বাবার ধারণা ফুলকাকা বড্ড বেশ চালবাজ, সে'টাই বাঁচোয়া। 

বাবা বলে "যে গান পছন্দ সে গানই শুনবি। গানও যদি অন্যের মতে শুনতে হয়, তা'হলে আর বেঁচে থেকে হবেটা কী"।



**



- এক্সকিউজ মী। এই যে আপনি..আপনাকে কি আমি চিনি?



- আরে, মিস্টার চ্যাটার্জী৷ হোয়াট আ প্লেজ্যান্ট সারপ্রাইজ। আমি আপনারই অপেক্ষায় বসেছিলাম তো৷ 

আমিই দুলাল।

- এই অঞ্চলে আমি এর আগে আসিনি৷ একটা জরুরী কাজে আচমকাই এ'দিকে..। এই চায়ের দোকানও আগে দেখিনি৷ আচমকাই চলে এলাম। আমি জানতাম না এই বেঞ্চিতে আপনি বসে থাকবেন৷ নেহাত আপনার মুখটা একটু চেনা ঠেকল..

তাই দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম। আর আপনি বলছেন আপনি আমার অপেক্ষায় বসেছিলেন?দুলাল নামে কাউকে কখনই আমি...।

- বহু বছর ধরে মাই লর্ড। বহু বছর ধরে আমি আপনার অপেক্ষায় বসে।

- কী'সব আজেবাজে কথা!

- বাজে কথাই যদি হবে, তা'হলে আপনার আমায় চেনা-চেনা ঠেকল কেন মিস্টার চ্যাটার্জী?যাক গে, খামোখা সময় নষ্ট কেন। যে কারণে এসেছেন, সে ব্যবস্থা করা যাক।

- এক মিনিট। আমি কী কারণে এসেছি? এ'সব হেঁয়ালির কী মানে দুলালবাবু?

- আপনি কি সত্যিই বুঝতে পারছেন না?

মিস্টার চ্যাটার্জী একটা পেল্লায় ঢোক গিললেন। বুকের ঢিপঢিপটা বেশ অস্বস্তিকর পর্যায় পৌঁছে গেছে। 



**



বাবার কাছ থেকে মাসে দু'টো ক্যাসেট কেনার টাকা পাওয়া যায়৷ তা দিয়ে বিভিন্ন হিন্দি সিনেমার ক্যাসেট খুঁজেপেতে নিয়ে আসে অর্ক৷ কিন্তু এই অদ্ভুত লোকটার অদ্ভুতুড়ে বাংলা গানগুলো কী'ভাবে যেন ভালো লাগতে শুরু করেছে তার। এক ক্লাসমেটের বাড়িতে গিয়ে ওঁর গান প্রথম শুনেছিল, তারপর থেকে খানিকটা নেশার মত হয়ে গেছে। কাজেই গত মাসের 'ক্যাসেট-বখশিশ' দিয়ে ওই দাড়িওলারই দু'দুটো ক্যাসেট কিনেছে সে। "তোমাকে চাই" আর "ইচ্ছে হল"। আপাতত অবশ্য "ইচ্ছে হল" অ্যালবামটাই অর্কর বেশি প্রিয়। 

আর এই ক্যাসেটে একটা গান অর্ক বার বার রিওয়াইন্ড করে শোনে; "বয়স আমার মুখের রেখায়..."।
গানটা যতবার শোনে, অর্কর মনের মধ্যে আশেপাশের বয়স্ক মানুষগুলো সম্বন্ধে একটা আলাদা রকমের মনকেমন তৈরি হয়। একটা কেমন ব্যথা মেশানো স্নেহ; সে ঠিক বোঝাতে পারে না। ওই ব্যথা, স্নেহ, মায়া, ভালোবাসা মিলে একটা অদ্ভুত ভালোলাগা। গানটার সুর যেমন, কথাগুলোও তেমনি সুন্দর। বাবার দূরসম্পর্কের মামা, কথায় কথায় ছড়া কাটা বিনোদদাদুর কথা মনে পড়ে, আসানসোলের দাদু-দিদার কথা মনে পড়ে, জামশেদপুরের অঙ্ক-পাগল বিমলজ্যেঠু,  এমন কি বাড়ির পাশের  মুদিখানায় বসে থাকা খিটখিটে জয়ন্ত জ্যেঠুর কথা ভেবেও মনটা সামান্য খারাপ হয়ে আসে। ওই বয়সে গিয়ে সবাই কি অল্প-বিস্তর একা হয়ে পড়ে? কে জানে। গত সাতদিন ধরে দুপুরবেলা নিয়মিত এই গানটা অন্তত বার তিনেক করে শুনছে অর্ক। 

**


চায়ের দোকানে বেঞ্চির ওপরই একটা ক্যানভাসের ব্যাগ রাখা ছিল। সেই ব্যাগটা তুলে নিয়ে বেশ একটা মাতব্বরে হাসি ছুঁড়ে দিলেন দুলালবাবু। মিস্টার চ্যাটার্জীর অস্বস্তি বেড়েই যাচ্ছিল। কিন্তু কিছুতেই সরে পড়তে ইচ্ছে করছিল না। আর কী আশ্চর্য, দোকানের অন্যান্য মানুষজন তাঁদের পাত্তাও দিচ্ছে না।

অন্তত আড়াই মিনিট সে ব্যাগ হাতড়ে দুলালবাবু ঘোষণা করলেন, "পেয়েছি মিস্টার চ্যাটার্জী, পেয়েছি"। 

**

সুমনের এই গানটা শুনতে শুনতে প্রতিবার বুকের মধ্যে একটা মোচড় টের পায় অর্ক। আজকেও পাচ্ছিল। আচমকা সামনের দেওয়ালে ঝোলানো আয়নাটার দিকে বুক ছ্যাঁত করে উঠল। 

**

ব্যাগ হাতড়ে একটা সস্তা দাড়ি কামানোর আয়না টেনে বের করলেন দুলালবাবু। 

- কই মিস্টার চ্যাটার্জী, এ'টার জন্যই তো এসেছিলেন। নাকি!

- এ'সব কী পাগলামো হচ্ছে দুলালবাবু?

- পাগলামো দেখেও তো পালিয়ে যাচ্ছেন না মিস্টার চ্যাটার্জী। দেখুন না, এ'টার জন্যই তো আপনি ছুটে এসেছেন। তাই না?

- এই আয়না? 

- দেখুন না।

- দেখার কী আছে! বিচ্ছিরি একটা আয়না। আর তা'তে আমি আর আপনি।

- সত্যিই তো। দেখার কী আছে। শুনুন। শুনুন। আয়নায় শুনুন।

- শুনব? আয়নায় শুনব?

- শুনুন না। মন দিয়ে।

মিস্টার চ্যাটার্জীর বুকের ভিতরে যেন কেউ ইটপাটকেল ছোঁড়াছুড়ি করছে।  গলা শুকিয়ে আসছে। স্পষ্ট হয়ে আসছে সব কিছু। খানিকটা কান্নাও পাচ্ছে তার। আর নিজেকে বড় ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে। বৃদ্ধ চ্যাটার্জী দিব্যি টের পাচ্ছিলেন যে আয়না থেকে ভেসে আসছে গান, "বয়স আমার, মুখের রেখায়..."। 

**
অর্ক হতবাক হয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে। সে নিজেকে দেখতে পারছে না। আয়না থেকে তার ঘরটাও হাওয়া। আয়নায় তখন দু'জন মানুষ দাঁড়িয়ে। দু'টোই অচেনা মুখ। একজনের উসকোখুসকো চেহারা, গালভরা হাসি। সে যেন অর্কর দিকে তাকিয়েই হাত নাড়ছে। আর তার পাশে একজন বয়স্ক মানুষ, নির্ঘাত বছর ষাটেক বয়স। এর মুখটা আবার অচেনা হয়েও চেনা। ভীষণ চেনা। সেই বুড়োটে আধ-চেনা মানুষটার চোখ ছলছল, যেন এই মাত্র কেঁদে ভাসাবেন। 

ও'দিকে ফিলিপ্স টেপ রেকর্ডারে সুমন অক্লান্ত ভাবে গেয়ে চলেছেন;
"গলার কাছে পাল তুলেছে আজগুবি এক স্মৃতির খেয়া
বয়স হওয়া মানেই বোধহয়; স্মৃতির সঙ্গে আড্ডা দেওয়া,
কে বলে হে আড্ডা নাকি কম বয়সের কথকতা
বয়স হলেই বরং জমে আড্ডা এবং নীরবতা"!

কয়েক মুহূর্ত মাত্র। তারপরই আয়না থেকে সেই দু'জন বিটকেল মানুষ হারিয়ে গেল। কাঁপা হাতে অর্ক টেপ রেকর্ডারের 'স্টপ' বোতামটা টিপল।

**

কয়েক মুহূর্তেই আয়না থেকে সুমনের সেই গান হারিয়ে গেল। ততক্ষণে সমস্তই জলের মত সহজ। ডুকরে কেঁদে উঠে দুলালবাবুকে জড়িয়ে ধরলেন অর্ক চ্যাটার্জী।

দুলালবাবু আয়না সরিয়ে রেখে শুধলেন, "এই বয়সে গিয়ে সবাই কি অল্প-বিস্তর একা হয়ে পড়ে মিস্টার চ্যাটার্জী"?

No comments: