Skip to main content

ফার্স্ট পার্সন


ঋতুপর্ণবাবুর মুখে ও কলমে বাংলাভাষা জ্বলজ্বল করে ওঠে। আমি ভাষার দুরূহ টেকনিকালিটি তেমন বুঝি না, কিন্তু আর পাঁচটা ধান্দাবাজ মানুষের মত নিজের আত্মার আরামটুকু দিব্যি টের পাই। ঋতুপর্ণবাবুর কথায় ও ভাষায় সাজানো ওঁর ভাবনাচিন্তা আর গল্পগুলো মনের মধ্যে সত্যিই আরাম বয়ে আনে। অগাধ পড়াশোনার মধ্যে বহুমানুষই থাকেন, ইন্টেলেক্টের ব্যাপারেও যে ঋতুপর্ণ শেষ কথা; সে নিয়ে কথা বলার যোগ্যতাও আমার নেই। তবে সিনেমাটিনেমা যদি বাদও দিই, কথাবার্তায় ওর সততা, সারল্য, যুক্তিনিষ্ঠা এবং সর্বোপরি ওর ভাষার যে 'সুমিষ্ট স্মার্টনেস'; সে'সব মিলে আধুনিক বাঙালি ঋতুপর্ণর ভক্ত না হয়ে যাবে কোথায়? (এটা অতিশয়োক্তি হল কিনা জানিনা, তবে আমি নিজে যেহেতু ঋতুপর্ণর "ভক্ত্", সে'সব নিয়ে "কেয়ার" করা আমার সাজে না)। তবে এই সততা, সারল্য, যুক্তিনিষ্ঠা আর ভাষার স্মার্টনেসের বাইরে গিয়ে দু'টো ব্যাপার ঋতুপর্ণকে অনন্য করে তোলে;
এক, ওঁর "এমপ্যাথি"।  
দুই, যে মধ্যবিত্ত আটপৌরে প্রিজমের মধ্যে দিয়ে ভদ্রলোক পৃথিবীর ইয়াব্বড় ব্যাপারস্যাপারগুলো দেখতে ও অনুভব করতে পারতেন৷

দে'জ থেকে প্রকাশিত ঋতুপর্ণর " ফার্স্ট পার্সন" বইজোড়ার পাতায় পাতায় সেই স্নেহ মাখানো মানুষটা৷ এদ্দিন কেন পড়িনি কে জানে, না পড়ে অন্যায় করেছি৷ যা হোক, গতকাল আমি প্রথম খণ্ডটা পড়ে শেষ করলাম৷ 
গত বছর দুয়েকে বেশ কিছু বায়োগ্রাফি পড়েছি আর অবশ্যই ঋতুপর্ণর এই বই কোনও মতেই জীবনী নয়,বরং পূর্ব প্রকাশিত গদ্যের সংকলন৷ অথচ এই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লেখাগুলোর মাধ্যমে কী চমৎকার ভাবে একটা নন-লিনিয়ার জীবনী তৈরি হয়েছে। বায়োগ্রাফি যদি স্রেফ "হিসেব সর্বস্ব" হয় তবে তা বেশ একঘেয়ে ঠেকতে পারে; "আমি এই করলাম, তারপরে ওই হল, তারপর আমি অমুক সাফল্য পেলাম আর শেষে গিয়ে তমুক হল"। এই "হিসেব সর্বস্বতা" র জন্যেই মাস্টারব্লাস্টার শচীনের জীবনীর চেয়ে মঞ্জরেকারের জীবনী অনেক বেশি চিত্তাকর্ষক। অমুকবাবুর জীবনীতে আমি স্রেফ উইকিপিডিয়া গোছের 'এন্ট্রি' গড়গড় করে পড়ে যেতে চাইনা, বরং আমি চাই অমুকের চোখ দিয়ে অমুকের পৃথিবীটাকে চিনতে। যে কোনও জীবনীতে আমি ইনফর্মেশন নয়, গল্প (আষাঢ়ে নয়) খুঁজে বেড়াই। আর সে'খানেই "ফার্স্ট পার্সন" য়ের প্রথম খণ্ডটা পড়ে মনে হল, কী চমৎকারভাবে ঋতুপর্ণবাবুর জীবনটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। অঙ্ক মেনে ছকে, জার্নাল লেজার ঘষেমেজে লেখা জীবনীর চেয়ে এ'টা একদিক থেকে ঢের বেশি ভালো। 
চাকরী সূত্রে আমার গত আটবছর কেটেছে যোধপুর পার্ক, প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড অঞ্চল ধরে; কলকাতার এই পরিচিত এলাকাগুলো ঋতুপর্ণর ছোটবেলার চোখ দিয়ে দেখতে পাওয়াটা একটা বাড়তি পাওনা। 
প্রথম খণ্ডের একজায়াগায় ঋতুপর্ণ নিজের মায়ের চলে যাওয়ার কথা লিখছেন৷ পাশাপাশি তুলে ধরছেন বৃদ্ধ অসহার পিতার একাকিত্ব। ও অংশটায় আমি বার পাঁচেক ঘুরপাক খেয়েছি। এবং তারপর থেকে সে অংশটুকু আমার মনের মধ্যে ক্রমাগত ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছে। নিজের সেই একঘেহে সঞ্জীব-ঘ্যানঘ্যানানিতে ফিরে গিয়ে বলি; ঋতুপর্ণ সঞ্জীবের গল্পের রূপকথা-মার্কা চরিত্রদের মত করে ভালোবাসতে পারতেন বলেই আমার মনে হয়৷

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু