Skip to main content

ফ্যাসিজমঃ আ ওয়ার্নিং


ফ্যাসিবাদ শব্দটা নিয়ে এখন চারদিকে বেশ কফিহাউস লেভেলে কপচানি চলছে। এটাও মেনে নিতে অসুবিধে নেই যে মতের অমিল হলেই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের গায়ে ফ্যাসিস্টের তকমা এঁটে দেওয়ার মধ্যে পপকর্ন-মুচমুচ থাকলেও, ব্যাপারটা সম্পূর্ণভাবে যুক্তিযুক্ত নাও হতে পারে। 
আর পাঁচটা নেটিজেনের মতই আমার ধৈর্য কম। দুম করে ওপিনিওন ঝেড়ে দিয়ে আমি তৃপ্তিলাভ করি আর রাজনৈতিক তর্কে নির্বিচারে 'ফ্যাসিস্ট" গোছের শব্দ জুড়ে দিয়ে আমি টেবিল চাপড়ে থাকি। সস্তা থ্রিল আমার মন্দ লাগে এমন কথা বললে বেশ 
অন্যায়ই হবে বটে। তবে ইদানীং মনে হচ্ছিল এই ফ্যাসিজম সম্বন্ধে সামান্য পড়াশোনা করলে নেহাত মন্দ হয়না৷ একদিকে বেশ ভজকট ব্যাপারে জানার ইচ্ছে আর অন্যদিকে শখের-প্রাণ-গড়েরমাঠ সিন্ড্রোম; কঠিন কন্সেপ্ট বুঝতে চাওয়া সহজ গল্প শোনার স্টাইলে। কাঠখোট্টা পাথুরে ভাষায় আরসালান বিরিয়ানির রিভিউ পড়লেও তা বাসি-পাউরুটি-মার্কা নিরস ঠেকতে পারে। সবচেয়ে ভালো হত যদি ফ্যাসিবাদের রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে সঞ্জীব বা পূর্ণেন্দু পত্রী কোনও প্রামাণ্য বই লিখতেন; তা নিশ্চিত ভাবেই আমার মত "কিশোর সমগ্র"-প্রাণ মানুষের জন্য সুখপাঠ্য হত। কিন্তু তেমন সরেস বইয়ের অপেক্ষায় থাকলেই হয়েছে আর কী। 

খানিকটা খোঁজখবর নিয়ে পড়া (শোনা, অডিওবুক) শুরু করলাম ম্যাডেলিন অলব্রাইটের "ফ্যাসিজমঃ আ ওয়ার্নিং"। সে অর্থে, ম্যাডেলিন ম্যাডাম যে নারায়ণ দেবনাথ-সুলভ সরল ভাষায় এ বই লেখেননি তা বলাই বাহুল্য। তবে দিব্যি তরতর করে এগিয়ে যাওয়া যায়। অলব্রাইট হলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন সেক্রেটারি অফ স্টেট; কাজেই তার লেখায় অবধারিত ভাবে প্রাধান্য পেয়েছে ডেমোক্র‍্যাট আমেরিকান পয়েন্ট অফ ভ্যিউ; কিন্তু তা'তে এ বইয়ে ধরা ইতিহাস তেমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বলেই আমার মনে হয়৷ 
বাঁধাধরা ফর্মুলা বা ডেফিনিশনে ফ্যাসিবাদকে বোঝা সম্ভব না হলেও, ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্যগুলোকে বিভিন্ন উদাহরণের মাধ্যমে চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ম্যাডেলিন অলব্রাইট। ফ্যাসিবাদ সম্বন্ধে আমাদের বেশির ভাগ ধারণাই সম্ভবত হিটলার এবং মুসোলিনি কেন্দ্রিক অথচ ফ্যাসিবাদ কোনো ছকে বাঁধা অঙ্ক নয় যে জার্মানির দুই যোগ দুই আর পাকিস্তানের দুই যোগ দুইতে কোনো ফারাক থাকবে না। বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে ফ্যাসিবাদী মনোভাব। সবচেয়ে বড় কথা সময়ের সঙ্গে ফ্যাসিবাদ এক জটিল বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে। উনিশশো তিরিশের দশকে ফ্যাসিবাদের যে চেহারা ছিল তার সঙ্গে আধুনিক ফ্যাসিবাদি হিসেবকিতেব সম্পূর্ণ খাপেখাপ নাও মিলতে পারে। 
এই চ্যালেঞ্জগুলো সত্ত্বেও অলব্রাইট যে'টা সফল ভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন সে'টা হল একটা সরকার বা নেতার ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটা। এই প্রক্রিয়াটাকে মোটের ওপর বুঝতে পারলেই হয়ত যে কোনো আধুনিক নাগরিক চিনে নিতে পারবেন অশুভ শক্তিগুলোকে। ব্যাপারটা টুক করে লিখে দেওয়াটা সহজ কিন্তু আত্মস্থ করা কঠিন; আরও কঠিন হল বোঝানো। 
যে কোনো সরকারি হঠকারিতাই কি ফ্যাসিস্ট কাজকারবারের সঙ্গে তুলনীয়? একনায়কতন্ত্র আর ফ্যাসিবাদে কি প্রায় একই ব্যাপার? এমন অনেক জটিল প্রশ্ন অত্যন্ত সহজভাবে আলোচনা করেছেন ম্যাডাম অলব্রাইট। আর বইজুড়ে যাবতীয় আলোচনার মূলে রয়েছে ইতিহাস। ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে শুধু জার্মানি আর ইতালিতে আটকে না থেকে লেখিকা চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছেন উত্তর কোরিয়া, তুরস্ক, পোল্যান্ড, হাঙ্গারি, রাশিয়া, মিশর, ভেনেজুয়েলাএবং আরও অনেক দেশের ফ্যাসিবাদী ইতিহাস। ফ্যাসিবাদের পলিটিকাল ইতিহাসের একটা চমৎকার প্রাইমার তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন লেখিকা, আর সেটা তৈরি করেছেন এমন ভাষায় যা সাধারণ পাঠকের জন্য সহজ ও মূল্যবান। মার্কিন।সেক্রেটারি অফ স্টেট হিসেবে নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় ভর দিয়ে যেভাবে পুতিন,শ্যাভেজ, কিম, ট্রাম্পের (এবং অন্য অনেক দেশনেতার) চরিত্রের বিশ্লেষণ করেছেন লেখিকা; তা অত্যন্ত মনোগ্রাহী। মোদ্দা কথা; ১৯৩০ দশক থেকে এই সময়; ফ্যাসিবাদের ইতিহাসকে বেশ 'কমপ্যাক্ট' ভাবে এই বইতে তুলে ধরেছেন ম্যাডেলিন অলব্রাইট। 
সবচেয়ে বড় কথা, ম্যাডেলিন চেষ্টা করেছেন ফ্যাসিজমের আগাম চিহ্নগুলোর দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। নাগরিকরা ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে লড়বে তাতে আর আশ্চর্য কী। কিন্তু আধুনিক নাগরিকের ওপর রয়েছে বাড়তি দায়িত্ব; তাঁকে ইতিহাস জানতে হবে এবং সেই জানার ভিত্তিতে সতর্ক হতে হবে যাতে আজকের সাদামাটা জনদরদী সরকার আগামীকালের ফ্যাসিস্ট না হয়ে ওঠে। আগামীকাল যে ফ্যাসিবাদ ধেয়ে আসছে, তার আগাম চিহ্ন আজকেই প্রকট হবে; নাগরিকদের তাই সতর্ক ও সচেতন না হয়ে কোনো উপায় নেই। 
সেই ক্লিশেটা এখানে বসিয়ে দেওয়াটা আমার কর্তব্য; রোমের মতই, হিটলারও একদিনে তৈরি হয়নি।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু