Skip to main content

রবি ঘোষের বই



আত্মজীবনী লেখায় বাঙালিদের যে কেন এত অনীহা কে জানে৷ রবি ঘোষের মত মানুষ যদি নিজের ভাষায় নিজের কাজকর্মের গল্প বিশদে লিখে যেতেন, বাঙালি বর্তে যেত৷ ওঁর মত গুণী মানুষদের ক্ষেত্রে যে'টা সবচেয়ে বড় ব্যাপার, ওঁদের কাজের ডিসিপ্লিন আর প্যাশন সম্বন্ধে পড়ে মুগ্ধ হওয়ার জন্য সিনেমার ছাত্র হওয়ার দরকার পড়েনা৷ বরং খানিকটা পড়েই মনে হয়; ইস, রবি ঘোষ যে'ভাবে অভিনয়ের গ্ল্যামারহীন দিকগুলোকেও অনুগত ছাত্রের চোখ দিয়ে দেখছেন, তেমন ভাবে আমিও যদি অফিসের পেন্ডিং ফাইলগুলো ঘাঁটতে পারতাম; তা'হলে রোজকার কাজটা কতটা উপভোগ্য হয়ে উঠত। তুলনাটা হয়ত বাড়াবাড়ি হল৷ তবে বক্তব্য হচ্ছে রবি ঘোষ স্তরের শিল্পীদের নির্বাণলাভের জন্য  গ্যালারি থেকে ভেসে আসা উচ্ছ্বাস আর হাততালিটাই শেষ কথা নয়৷ কাজের ডিসিপ্লিনে ডুবে থাকাটাই সম্ভবত তাঁদের মূল ইনসেন্টিভ৷ আমার মত মানুষ, যার শিল্প জগতের সঙ্গে এতটুকু সুতোর যোগই  নেই, যদি শিল্পীদের প্যাশন সম্বন্ধে একটা আইডিয়া পেতে চাই; তা'হলে রবি ঘোষের মত স্টলওয়ার্টদের লেখাই কুড়িয়ে-কাছিয়ে পড়তে হবে৷ কুড়িয়ে-কাছিয়ে ভদ্রলোকের খুচরো লেখাগুলো জড়ো করার দুরূহ কাজটা করা হয়েছে  "আপনমনে" বইটাতে৷ সম্পাদক অভীক চট্টপাধ্যায় এবং সপ্তর্ষি প্রকাশনকে ধন্যবাদ৷ ভদ্রলোক জীবনী লেখার বা লেখানোর কোনও চেষ্টা যখন করেননি, তখন আমাদের দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো ছাড়া আর কোনও উপায় নেই৷ 

বইটা স্রেফ একটা প্রবন্ধ সংকলন, রবিবাবু বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় যে'সব লেখা দিয়েছেন; সে'গুলোই জড়ো করে ছেপে দেওয়া হয়েছে৷ লেখাগুলো বেশিরভাগই টপিকাল, কাজেই কিছু ঘটনা, অনুভূতি ও অভিব্যক্তি বারবার ঘুরেফিরে এসেছে৷ তা সত্ত্বেও বইটা আমার খুব ভালো লেগেছে। কেন?

প্রথম কারণটা বলেইছি৷ কর্মযোগ যে কী ফ্যান্টাস্টিক ব্যাপার, সে'টা এ বই পড়লেই মালুম হবে৷ একটা মানুষ নিজের কাজের মধ্যে ডুবে আছেন, কাজের ভালোবাসায় নিজেকে ভাসিয়ে দিচ্ছেন৷ আর নিজেকে ঠুকেপিটে রোজ একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছেলেন 'নেক্সট-লেভেল-এক্সেলেন্সের' দিকে৷ সে'টা যে কী দারুণ একটা অ্যাডভেঞ্চার।  দ্বিতীয়ত, সেই সময়, সে'সময়ের কলকাতা, সে'দিনের বাংলা অভিনয় আর সে'যুগের মানুষজনদের ব্যাপারে একটা ছিমছাম প্রাইমার রয়েছে এই প্রবন্ধগুলোর মধ্যে৷ আর একটা জব্বর ব্যাপার হল উৎপল দত্ত আর সত্যজিৎ রায় সম্বন্ধে রবি ঘোষের অবজার্ভেশনগুলো; সে'গুলো আমি খোলসা করতে গেলে খেলো হয়ে যাবে৷ রবি ঘোষের ভাষাতে পড়াই ভালো৷ 

বইটার আর একটা দুর্ধর্ষ ব্যাপার হল বাংলা সিনেমায় কমেডি এবং কমিক অভিনয় সম্বন্ধে ওঁর মতামত, খেদ আর অভিমান। সমাজ-ব্যবস্থার সঙ্গে সিনেমার হাসির যোগাযোগ নিয়ে চমৎকার কিছু মনোলগ লিখে গেছেন ভদ্রলোক; সে'গুলো যতটা ধারালো, ততটাই হতাশা মেশানো৷ আর ভদ্রলোকের ভাষার উইট মিশে লেখাগুলো বেশ রসালোও হয়েছে। সত্যজিতের স্ক্রিপ্ট থেকে উঠে আসা নটবর মিত্তিরের মতই তার কথাগুলো স্মার্ট, সাবলীল, মজারু, এবং সরলসিধে৷ আর একটা ব্যাপার, ভদ্রলোক যাই লিখেছেন সে'টা পড়লে মনে হবে টেবিলের ওপারে চায়ের কাপ নিয়ে বসে বলছেন। কাজেই তার বাংলায় চলে এসেছে প্রচুর ইংরেজি শব্দ যা আমরা সাধারণ কথাবার্তায় দিব্যি বলে থাকি৷ আমার অবশ্য সে'টা ভালোই লেগেছে। এই বই নিয়ে লিখতে বসে তাই দিব্যি ইংরেজি শব্দগুলো ফিল্টার না করে চালিয়ে গেলাম৷ 

আর একটা ব্যাপার প্রশংসার দাবী রাখে। প্রত্যেক প্রবন্ধের শেষে যত্ন করে টীকার লিস্ট সাজিয়েছেন সম্পাদক৷ আর ফুটনোটের মত কিপটেমি করে লেখা নয়, গুছিয়ে লেখা এক একটা প্যারাগ্রাফ৷  আমার মত কম-জানা মানুষজনের জন্য যা বেশ কাজের জিনিস৷ এই যেমন সেই টীকা পড়েই জেনেছু অভিনেতা সত্য বন্দোপাধ্যায় জার্মান ভাষা জানতেন আর রবি ঘোষই শর্মিলা ঠাকুরকে কমলকুমার মজুমদারের কাছে নিয়ে গেছিলেন অভিনয় শেখাতে৷ 

কাজেই, যদি না পড়ে থাকেন, তা'হলে বইটা চট্ করে সংগ্রহ করে নিতেই পারেন। 

Comments

Arya Biswas said…
বাহ্ কি সুন্দর লেখাটা।
রবি ঘোষ সম্পর্কে সত্যি খুব কম জানা আছে। বইটা নিশ্চয়ই পড়বো।
ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু