Skip to main content

ভাণু সমগ্র



ভানুবাবুর লেখালিখিগুলো(ওঁর নিজের লেখালিখি আর ওঁর সম্বন্ধে অন্যদের লেখালিখি) জড়ো করে একটা দুর্দান্ত কাজ করেছে পত্রভারতী। এই ভানু সমগ্রের অর্ধেক জুড়ে রয়েছে ভদ্রলোকের একটা জমজমাট আত্মকথা, বইয়ের মূল আকর্ষণ সে'টাই।
বড় শিল্পীদের আত্মকথা অনেকক্ষেত্রেই "গোস্ট রিটেন" হয়। তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়না বোধ হয়। কিন্তু ভানুবাবুর লেখার সোজাসাপটা স্টাইল,তাঁর কপিবুক ধারালো উইট এবং রসালো
আড্ডার যে মেজাজ প্রায় প্রতিটি লাইনে রয়েছে; তা'তে মনে হয় এ জিনিস এক্কেবারে "রাইট আউট অফ হর্সেস মাউথ" না হলেই নয়। সাহিত্যের নিয়মকানুন রুচির তোয়াক্কা তেমন করেননি। গোটাটাই একটা দিলখোলা গপ্পগুজব, ওঁর সেই "একপেশে স্টাইলে"। পাঠক হিসেবে বরাবরই মনে হয়ে ভালো আত্মকথায় স্রেফ "আমি,আমি,আমি" থাকলে সমস্তটাই মাটি। আমার অমুক, আমার তমুকে আটকা পড়ে বহু সম্ভাবনাময় বায়োগ্রাফি ভেসে গেছে। ভারতীয় ক্রিকেট তারকাদের কিছু জীবনে সে ব্যাপারে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু ভানুবাবুর এই ছোটখাটো লেখার ক্ষেত্রে আর যাই হোক সে অভিযোগ আনা যায় না। ভদ্রলোক নিজের জীবনের একটা ফ্লো দিব্যি সাজিয়েছেন বটে। তবে তাঁর লেখায় দুর্দান্তভাবে স্পষ্ট হয়েছে সে সময়ের বাংলা সিনেমা জগতের বেশ কিছু জরুরী ব্যক্তিত্ব। সে'সময়ের বাংলা সিনেমার (বিশেষত বিয়ন্ড-সত্যজিৎ জগতের) লেজেন্ডদের বিষয়ে লেখালিখি ঠিক সহজলভ্য নয়। ভানুবাবুর এই গল্পগাছা সে আগ্রহকে খোঁচা দেয় বইকি। মাঝেমধ্যে সিনেমার বাইরেও গিয়ে পড়েছেন ভানু। তাঁর বর্ণময় জীবন তুলে ধরতে গিয়ে উঠে এসেছে দেশভাগ, কলকাতা, রাজনীতি আর আরও কত কী।
লেখাটা পড়তে গিয়ে বারবার মনে হইয়েছে বাংলা সিনেমার সে'যুগের মানুষজন সম্বন্ধে আমরা (অন্তত আমি) কত কম জানি। সিনেমার স্ক্রিনের বাইরেও তাঁদের সরেস উপস্থিতি, ব্যক্তিত্ব, রকমারি বাতিক; এ'সব আর এ'যুগের মানুষের দৃষ্টিগোচর হল কই। এই যেমন ক্যামেরা বা স্টেজের আড়ালেও ছবি বিশ্বাসের যে কী সাংঘাতিক একটা দুনিয়া-কাঁপানো স্টাইল ছিল! ছবিবাবুকে নিয়ে একটা পেল্লায় বই লেখা উচিৎ, তরতরে ঝরঝরে ভাষায়। সে কাজটা কে করবেন আমার জানা নেই। অভিনেতা ছবি বিশ্বাস সকলের অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। তবে ভানু খোলসা করেছেন ওঁর ব্যক্তিগত স্টাইল আর হিউমরের দিকটা। আমার চোখে সে'টাই এ বইয়ের অন্যতম হাইপয়েন্ট। এই যেমন ধরুন স্টেজে সহঅভিনেতাদের কী'ভাবে ভড়কে দিতেন ছবিবাবু? বিকাশবাবুকে 'বেগুনপোড়া'র সঙ্গে তুলনা করেছিলেন কেন? উত্তমকুমারকেই বা ছবিবাবু ঠিক কী'ভাবে ইন্সপ্যায়ার করেছিলেন? আর নিজের জমিদার মেজাজের ঘ্যাম কী'ভাবে 'ক্যারি' করতেন ভদ্রলোক? প্রাণখুলে লিখেছেন ভানুবাবু। তবে শুধু ছবি বিশ্বাস নয়। উত্তমের ফোকাস, সাবিত্রীর দুর্দান্ত প্রতিভা, বিকাশ রায়ের ইন্টেলিজেন্স, পাহাড়ি সান্যালের সারল্য; এমন আরও কত মানুষ সম্বন্ধে কত কিছু। তবে শুধু প্রশংসায় আটকে যাওয়ার মানুষ তো ভানু নন। কড়া কথা এবং অভিযোগগুলোও চেপে রাখার প্রয়োজন মনে করেননি।
সেই সময়ের কমার্শিয়াল বাংলা সিনেমা জগতের পরিবেশ, রাজনীতি, আর সম্পর্কগুলো সম্বন্ধে বেশ সোজাসাপটা ভাষায় লিখেছেন ভদ্রলোক। সে'দিক থেকে এ লেখা যাকে বলে বেশ জরুরী দলিল। সবচেয়ে বড় কথা, অভিনয় আর কমেডি সম্বন্ধে কিছু জরুরী অবজার্ভেশন শেয়ার করেছেন তিনি। রবি ঘোষও নিজের জীবনীতে অভিনয়ের টেকনিকালিটি নিয়ে মনোগ্রাহী স্টাইলে বেশ কিছু জরুরী কথা লিখেছেন। ভানুবাবুর লেখার মধ্যেও একই প্যাশন। রবিবাবু যেন একটু বেশি সেরেব্রাল,ভানু খানিকটা প্র্যাক্টিকাল। বাংলা সিনেমার অতিরিক্ত কান্না-প্রীতিতে দু'জনেই বিরক্ত এবং হতাশ। আর সিনেমায় রিলিফের খাতিরে কমেডির অপব্যবহারে দু'জনেই মর্মাহত।
ভানুবাবুর কেরিয়ার কার্ভটা বড্ড সিনেম্যাটিক। কমেডিতে আসর কাঁপানোর পাশাপাশি সিনেমার হিরো হয়েও বিভিন্ন সিনেমা হিট করিয়েছেন। বেশ নেতাগোছের মানুষ। সাঙ্ঘাতিক উইট এবং রসবোধ। সেই উইট ছাপিয়েই তিনি আবার দামাল, দুর্দান্ত। ঠাস ঠাস করে কড়া কথা শোনাতে পারেন। খানিকটা বেপরোয়া (নইলে অন্যদের ব্যাপারে অমন কামান দাগা সম্ভব নয়। নিজের ছেলেকেও রেয়াত করেননি অবশ্য)। সেই বেপরোয়া বিচ্ছু ভদ্রলোকই একটা সময় এসে নিজেকে ভাঁড় হিসবে সিনেমায় দাঁড় করাতে বাধ্য হয়েছেন; বারবার। ওই, প্রেম,ট্র্যাজেডি এ'সবের ফাঁকে দর্শকদের কমিক রিলীফ যোগাতে হবে। কমেডিয়ান এসে উঁচু মাত্রায় কিছু চুটকি মাঠে ফেলবেন। ওঁর মত ধারালো অভিনেতাকেও সেই টেমপ্লেটের বশ্যতা স্বীকার করতে হয়েছিল। আবার একটা বয়সের পর সে'সুযোগগুলোযও হারিয়ে যেতে শুরু করেছিল। রাগ, বিরক্তি, অভিমান আর সর্বোপরি টাকার অভাব; সব মিলে বাধ্য হয়ে এগোলেন যাত্রাকে এক্সপ্লোর করতে। কিন্তু জাত শিল্পীদের ব্যাপারটাই আলাদা। আমরা কর্পোরেটে একটা বুলি খুব কপচাই; যাই করো, এক্সেলেন্স থেকে ফোকাস সরলে চলবে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা বলি এক্সেলেন্স আর বানাই গাম্বাট পাওয়ারপয়েন্ট। ভানুবাবু তো কর্পোরেট স্টুজ নন, শিল্পি। যাত্রাতে লোক মাতালেন। আর্টফর্মটাকে ভালোবাসলেন। সিনেমাতেও দুর্দান্ত কিছু কামব্যাক পারফর্ম্যান্স দিলেন। কিন্তু কমেডিয়ান তকমাটা আর ঝেড়ে ফেলতে পারলেন না। এই যে দুর্দান্ত একটা কার্ভ, যে'টা শুধুই 'রাইজিং' নয়, ভানুবাবুর প্রাণখোলা লেখার গুণে সে'টা একটা চমৎকার নভেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজের বিরক্তির ওপর সাহিত্যের পালিশ চালাননি ভদ্রলোক, সে'টাই এই লেখার বড় ব্যাপার।
উত্তমের গালে চুমু খেতেন ভানু, সৌমিত্রর প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা- নিজের গার্জেন বলে মনে করতেন, সত্যজিৎকে সম্মান করতেন আবার সামান্য় অভিমানও পুষে রেখেছিলেন। ও'দিকে গুপী গাইন বাঘা বাইন রিলিজের সময় উত্তম আর ভানু একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিলেন। অবাক কাণ্ড, সত্যজিতের সিনেমায় চান্স না পাওয়া ভানু কিন্তু ছিলেন সত্যজিতেরই দলে। নিশ্চিন্তে থাকুন; এ'গুলো স্পয়লার নয়, খোঁচা। এইসব ইনফর্মেশনগুলো আড়ালে যে'সব রিয়েললাইফ গল্প লুকিয়ে আছে, সে'গুলোকে টেনে বের করে আনতে হলে এ লেখা পড়া ছাড়া উপায় নেই। বাংলা-সিনেমার ভক্তদের জন্য সে'সব অ্যানেকডোটের মূল্য অপরিসীম। তবে সেই সিনেমার জগতের পরিচয়টাই ভানুবাবুর বায়োডেটার শেষ কথা নয়। ওঁর শিক্ষকদের একটা ফর্দ করলে তাজ্জব বনে যেতে হয়। দীনেশ গুপ্ত থেকে সত্যেন বসু হয়ে আর কত দুর্দান্ত সব মানুষ। আর সবচেয়ে বড় কথা, দেশভাগের জ্বালাযন্ত্রণা তাঁর কমেডির সঙ্গে মিলেমিশে গেছিল।
ভানুবাবুকে নিয়ে একটা জবরদস্ত বায়পিক কে বানাবেন? স্নেহ-ভালোবাসা-ট্র্যাজেডি; মশলাপাতির তো অভাব নেই। শুভস্য শীঘ্রম!

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

ব্লগ-বাজ

আর চিন্তা নেই । বাঙালিকে আর রোখা যাবে না । আর সামান্য (সম্ভবত কিঞ্চিত গোলমেলে ) কবিতা ছাপাবার জন্যে সম্পাদক কে তোল্লাই দিতে হবে না । আর প্রেমে লটরপটর হয়ে ডায়েরি লিখে প্রাণপাত করতে হবে না। পলিটিক্স কে পাবলিক-জন্ডিস বলে গাল দেওয়ার জন্য আর “প্রিয় সম্পাদক” বলে আনন্দবাজারের ঠ্যাং ধরতে হবে না। কেন ?  হোয়াই? বাঙালি ব্লগিং শিখে গ্যাছে যে। ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে শাণিত তলোয়ারের মত “ পোস্ট”-সমূহ জনতার ইন্টেলেক্ট এসপার-ওসপার করে দেবে ; হাতে-গরম গায়ে-কাঁটা। বাঙালি মননের নব্য জিস্পট ; ব্লগ-স্পট । কে বলে যে বাঙালি ব্রিগেডে বুক্তুনি দিয়ে আর ফুটবল মাঠে খেউড় করে খতম হয়ে গ্যাছে ? কে বলে যে বাঙালির ঘিলু কফি হাউসে ভাত ঘুমে মগ্ন ? বাঙালিকে একবার ব্লগখোর হতে দিন , সমস্ত অভিযোগ ভ্যানিশ হয়ে যাবে । পোপ থেকে পরশুরাম ; ডেঙ্গু থেকে মশাগ্রাম ; বং-ব্লগের দাপট রইবে সর্বত্র । বাঙালির সমস্ত আশা-ভরসা-জিজ্ঞাসা এইবারে ব্লগ মারফত্‍ পৌছে যাবে ট্যাংরা ট্যু টেক্সাস । তোপসে মাছের স্প্যানিশ ঝোলের রেসিপি কী ? বাঙাল-ঘটি মিল মহব্বত-হয়ে গেলে কি বাঙ্গালিয়ানা চটকে যাবে ? নেতাজী কি এখ

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু