Skip to main content

তিনটে বত্রিশের ব্যান্ডেল লোকাল

স্পষ্ট কেউ ডাকলে৷
স্পষ্ট৷ কণ্ঠস্বরটা এখনও কানে বাজছে নির্মলবাবুর৷ গলাটা কি পরিচিত?
"নিমু, ও নিমু। আয়, একবার এ'দিকে আয়"।
ধুস৷ ও নামে অফিসে আবার কে ডাকবে৷ অফিসে তাঁকে নির্মল বলেই কেউ ডাকেনা; মিস্টার দত্ত বা দত্তবাবু বা দত্তদা বা দত্তসাহেব৷ অফিসের ঘানিটানাটানির মধ্যে নিমু ডাকটা ঠিক ওই স্যালাডের মধ্যে হাইক্লাস হিমসাগরের টুকরোর মত৷
নিশ্চয়ই ভুল শুনেছেন৷ নিশ্চয়ই৷
অস্বস্তিটা ঝেড়ে ফেলে ফের কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে মন দিলেন নির্মলবাবু৷
একটা মস্তবড় স্প্রেডশিট৷ সে'টাকে দলাইমলাই করে মোক্ষম কিছু হিসেবনিকেশ দাঁড় করাতে হবে৷ এর জন্য দরকার নিরবচ্ছিন্ন মনযোগ৷ আর..আর একটা ব্ল্যাককফি৷
" আহ, নিমু! এ'দিকে৷ এ'দিকে দেখ"।
এ'বারে একটু তড়াং হতে হলো৷ ফের কানে এলো, স্পষ্ট৷ কেউ ফচকেমো করছ না তো? উঁহু, তিনি নিজে বেশ ভারিক্কি মেজাজের মানুষ, অফিসে বেশ তালেবর পোজিশন বাগিয়ে বসে রয়েছেন৷ তাঁর সঙ্গে এ'সব ফাজলামো কেউ করবে না৷ ঢকঢক করে খানিকটা জল খেলেন৷ চেয়ার থেকে উঠে চেম্বারের মধ্যেই খানিকটা হাঁটাচলা করে নিলেন৷ তারপর কিছুটা ধাতস্থ হয়ে ফিরলেন নিজের পেল্লায় অফিস-চেয়ারটায়৷
"নিমু! ফের বসে পড়লি? বেরো দেখি"৷
এ'বার নিজের চেম্বার থেকে হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এলেন নির্মলবাবু৷ বুকের একটা অস্বস্তিকর ধড়ফড়৷ পিওন বিশু ছুটে এলো৷
- কিছু চাইছেন স্যার?
- উঁ...ইয়ে৷ হ্যাঁ রে বিশে, কোনও অচেনা কেউ কি আমার জন্য অপেক্ষা করছে?
- কই! না তো।
- ঠিক আছে৷ আমি একটু নীচ থেকে ঘুরে আসছি৷
- ও মা৷ গোল্ডফ্লেক আনতে হবে নাকি স্যার? আমায় বলবেন তো! এখুনি এনে দিচ্ছি৷
- না না৷ দরকার নেই৷ আমিই বেরোচ্ছি৷ একটু হাওয়া খাওয়া যাবে'খন৷
অফিসের নীচেই মনোহরলালের পানের দোকান৷ সে'খান থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে মিনিট পাঁচেক হাঁটাহাঁটির পর নির্মলবাবুর মনে হল, "নাহ্, সত্যিই এ এক বিশ্রী ভীমরতি"! সিগারেটটা কাছের ডাস্টবিনে ছুটে ফেলে অফিসের দিকে পা বাড়ালেন নির্মলবাবু।
" নিমু, ফের অফিস? তিন বত্রিশের ব্যান্ডেল লোকালটা ধরতেই হবে"।
ফুটপাতে দাঁড়িয়ে৷ ভীড়ের হইচই, বাসট্রামের গোলমাল ছাপিয়েও স্পষ্ট শুনতে পেলেন সেই মিহি পুরুষকণ্ঠ৷ গা শিরশির করে উঠল নির্মলবাবুর৷ ব্যান্ডেল লোকালে শেষ পা দিয়েছেন অন্তত বাইশ বছর আগে৷ শেষ যে'বার পাড়ায় ফিরেছিলেন৷ ছোটবেলার সে পাড়ার কথা মনে পড়তেই কেমন বুকটা চিনচিন করে উঠল৷ আহ্৷ কদ্দিন বাড়ি ফেরা হয়না৷ কলকাতার ফ্ল্যাটটাকে এখনও ঠিক বাড়ি হিসেবে আপন করে নেওয়া হলো না৷ কিন্তু এদ্দিন পর পাড়ায় ফিরে হবেই বা কি? সে'খানকার পাট তো কবেই চুকেবুকে গেছে৷
"নিমু৷ ট্রেনটা মিস করিস না"৷
আবার!
এ'বার ঝোঁক চেপে গেল। বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিলেন ফিরতে দেরী হবে৷ আর তৎক্ষণাৎ ট্যাক্সি ধরে সোজা হাওড়া স্টেশন৷ মাঝপথে সেই কণ্ঠস্বরটা আর একবার কানে ভেসে এসেছিল - "হাওড়ার মিনিটা ধরলেই পারতিস৷ খামোখা ট্যাক্সি ধরে বাড়তি কিছু টাকার জলাঞ্জলি"।
বৈদ্যবাটির টিকিট কেটে যখন নির্মলবাবু তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে গিয়ে পৌঁছলেন, তখন তাঁর বুকের মধ্যে একটা বিশ্রী ধড়াস ধড়াস৷ তিনটে বত্রিশের ব্যান্ডেল লোকাল তখন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে৷ আর মিনিট পাঁচেকের মাথায় ছেড়ে দেবে৷।
ট্রেনে ভীড় ছিল না৷ পছন্দমত একটা জানালার সীট বেছে নিয়ে বসেছিলেন তিনি৷ যাত্রাপথে আরও দু'বার সেই কণ্ঠস্বর শুনতে হয়েছিল নির্মলবাবুকে৷
" নিমু, দু'প্যাকেট কাঠিভাজা কেন দেখি"।
"নিমু, দু'প্যাকেট বাদাম কিনে রাখ ভাই"৷
বৈদ্যবাটি স্টেশনে নেমেই মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল নির্মলবাবুর৷ এ'টা আর যাই হোক দেজাভু নয়৷ এত বড় ব্যাপারটা তিনি ভুলে গেছিলেন কী করে? পকেট হাতড়ে মোবাইলফোনটা বের করে দেখলেন ফোনে সিগনাল নেই৷ স্বাভাবিক, যে'খানে তিনি এসে পড়েছেন সে'খানে মোবাইল ফোনটা থাকারই কথা নয়৷
***
- আমার কেমন নার্ভাস লাগছে বেবুলমামা।
- মাধ্যমিক দিয়ে ফেলেছিস৷ এখন তুই রীতিমতো অ্যাডাল্ট! কথায় কথায় এত নার্ভাস হওয়ার কী আছে? বি স্টেডি। আর মিনিট পাঁচেক। ট্রেন এলো বলে।
- ট্রেন এলে সত্যিই সে'টা ঘটবে?
- বেবুল সান্যালের অকাল্ট পাওয়ারকে পাড়ার লোকে পাত্তা না দিক৷ কিন্তু আমি হলফ করে বলছি নিমু; আমার তিব্বত সফর বৃথা যায়নি৷ আর সে'টা এ'বার আমি হাতেনাতে প্রমাণ করব!
- এই ট্রেন থেকে আমি নামব?
- ভবিষ্যতের তুই৷ মধ্যবয়স্ক তুই৷ ভবিষ্যৎ থেকে তোকে টেনে আনছি আমার মন্ত্রবলে৷ তিব্বতি তন্ত্র ব্যবহার করে সেই ভবিষ্যতের নিমুর সঙ্গে আমি যোগাযোগও স্থাপন করেছি৷
- যত আজেবাজে কথা৷ ধুস৷ আমি আসি৷
- আরে দাঁড়া না ইডিয়ট৷ ওই যে, ট্রেন ঢুকছে৷
- বাবা ঠিকই বলে৷ তুমি একটা ঢপবাজ৷
- তোর বাবা একটা অখাদ্য মানুষ৷ ব্যবসা করে করে স্রেফ বখে গেল। ওই যে৷ ট্রেন ঢুকে গেছে৷ এ'বার তুই নামবি৷ মানে ভবিষ্যতের তুই। রীতিমত কোট-টাই পরা সাহেবসুবো মানুষ৷ আমি মেডিটেট করতে বসে সে চেহারে আগেভাগেই দেখে রেখেছি।
- বাবা কি সাধে বলে বেবুলটা মহাফেরেব্বাজ!
- তোর বাবা একটা ইডিয়ট৷ থাম৷ ওই যে তুই। তুই আমাদের জন্য কাঠিভাজা আর বাদাম নিয়ে এসেছিস৷ আমি শিওর!
- ওই ধুমসো টেকো খিটখিটে চেহারার লোকটা আমি? ওই হাতের কী একটা খেলনার দিকে তাকিয়ে হাবার মত দাঁড়িয়ে আছে, ও'টা আমি? তাও ভবিষ্যৎ থেকে তোমার মন্ত্রবলে টেনে আনা? মামা, এ খবর জানলে বাবা তোমায় ছাতাপেটা করবে৷ ভুজুংভাজুংয়ের একটা লিমিট থাকবে না? তোমার শ্রীরামপুরের থিয়েটারের দলের কোনও লোককে সেট করেছ নিশ্চয়ই!
***
নির্মলবাবুর স্মৃতি হুড়মুড়িয়ে ফেরত এলো৷ তাই তো৷ তাই তো৷ যে বেঞ্চিটার কাছে দু'জনের দাঁড়িয়ে থাকার কথা সোজা সে'দিকে হাঁটা লাগালেন তিনি৷ ওইত্তো দাঁড়িয়ে বেবুলমামা৷ বেবুলমামার পাশে একমুখ বিরক্তি মেখে দাঁড়িয়ে থাকা এক কিশোর৷ সে ছেলেটা সম্ভবত সরে পড়তে চাইছে কিন্তু বেবুলমামা তার জামার আস্তিন টেনে ধরে আছে বলে ছুটে পালাতে পারছে না৷
হাওড়ামুখো একটা ট্রেন ঢুকছে৷ নির্মলবাবু বিলক্ষণ জানেন তাঁর কী করার কথা৷ একছুট্টে সেই দু'জনের কাছে পৌঁছে গেলেন তিনি৷ বেবুলমামাকে ঢিপ করে একটা প্রণাম করে, পাশে দাঁড়ানো ছেলেটির হাতে বাদাম আর কাঠিভাজার প্যাকেটগুলো গুঁজে দিয়েই ফের ছুট৷ হাওড়ামুখো ট্রেনটা কিছুতেই মিস করা চলবে না৷

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু