Skip to main content

ননীগোপালের খেল


১।

ল্যাম্পপোস্টে সাঁটা পোস্টারটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন ভবদুলাল মিত্র। ভরদুপুরে এমন দুম করে শশব্যস্ত ফুটপাথের মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ায় বিস্তর ধাক্কাধাক্কি সহ্য করতে হচ্ছিল তাকে। কিন্তু পোস্টারের ওপর থেকে কিছুতেই চোখ সরাতে পারছিলেন না তিনি। পোস্টারে একজন জাদুকরের মুখের স্কেচ৷ মুখটা গোলগাল, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, সরু শৌখিন গোঁফ আর ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি৷ মাথায় একটা প্রকাণ্ড পাগড়ি। ওই সাদামাটা ময়লা পোস্টারটা যেন উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে সেই জাদুকরের আলো আলো হাসিতে। 

আশেপাশের একটা মানুষও সে পোস্টারটার দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়াচ্ছে না। অথচ সে জাদুকরের মায়াময় হাসির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে খানিকটা যেন বিহ্বল বোধ করছিলেন ভবদুলালবাবু। সামান্য মাথা ঝিমঝিমও শুরু হয়েছিল৷ হলুদ কাগজের ওপর কালো কালিতে ছাপানো সে পোস্টারটি অতি সাধারণ,  চোখে না পড়ার মতই। ঘোরটা কিছুক্ষণ কাটলে ভবদুলালবাবু ল্যাম্পপোস্টটার কাছে এগিয়ে গেলেন পোস্টারের লেখাটা পড়তে।

"জাদুসম্রাট ননীগোপাল হালদারের ইন্দ্রজাল"।
আগামী শো; বাইশে অগস্ট, ১৯৯২"।

১৯৯২। ১৯৯২। ১৯৯২। 

উনিশশো চুরানব্বই সালের ল্যাম্পপোস্টে এই পোস্টার কীভাবে এলো তা কিছুতেই ঠাহর করতে পারছিলেন না ভবদুলালবাবু। তাঁর চোখ ফের আটকা পড়লো জাদুকর ননীগোপালের হাসি হাসি মুখটায়৷ মুখটা তাঁর চেনা। ভবদুলালবাবুর পা'দুটো যেন অবশ হয়ে পড়েছিল। চারদিকে হঠাৎ একটা বিশ্রী হইহল্লা শুরু হল, কিন্তু সেই বিকট শব্দসমূহ মোহাচ্ছন্ন ভবদুলালবাবুর কানে আদৌ পৌঁছল না।

জাদুকর ননীগোপাল আর এই পোস্টার; সমস্তটাই ভবদুলালবাবুর চেনা। বড্ড চেনা।

২।

- তাই বলে এই সামান্য একটা ব্যাপারের জন্য আমার চাকরী গেল?

- ইয়েস। ফিনান্সে বলে দিয়েছি৷ নিজের পাওনাগণ্ডা বুঝে নিয়ে এখুনি বিদেয় হও।

- আমার অপরাধ আমি শখের ম্যাজিশিয়ান?

- মিত্র কেমিক্যালসের একজন সিনিয়র এক্সেকিউটিভ পাড়ায় পাড়ায় সস্তা ম্যাজিক দেখিয়ে বেড়াবে আর এমডি হয়ে সে'টা আমি বরদাস্ত করব ভেবেছ?

- কিন্তু অফিসের কাজে আমায় কোনওদিনও ফাঁকি দিতে দেখেছেন ভবদুলালবাবু?

- শোনো অরিন্দম, তুমি একটা দায়িত্ববান পদে ছিলে৷ অনেক আশা নিয়ে এ বছর আমি তোমায় প্রমোটও করেছিলাম, সঙ্গে মোটাটাকার ইনক্রিমেন্ট। হাইপ্রোফাইল ক্লায়েন্টদের সঙ্গে তোমার ডিল করার কথা৷ এ'দিকে গত রবিবার ভবানীপুরের মনোহরলাল সিঙ্ঘানিয়া তোমায় দেখেছে পাড়ার সস্তা অনুষ্ঠানে ম্যাজিক দেখাতে। তাও আবার জাদুসম্রাট ননীগোপাল নামে। সিঙ্ঘানিয়ার আর তোমায় সিরয়াসলি নেবে ভেবেছ? তোমার পাশাপাশি মিত্র কেমিক্যালসের রেপুটেশনও গোল্লায় যাবে। যাক গে। নাউ লীভ।

- আমার এই সামান্য শখের জন্য কোম্পানির সম্মানহানি ঘটবে ভবদুলালবাবু?

- ঘটেছে। সিঙ্ঘানিয়া বলেছে যে কোম্পানির সিনিয়র এক্সেকিউটিভ এমন ভাঁড়ের মত রঙ্গ-তামাশা করে বেড়ায়, সে কোম্পানির সঙ্গে সে কোনও ডীল করবে না৷ তুমি স্টেজে ডেকে মিসেস সিঙ্ঘানিয়ার কান থেকে কেউটে সাপ বের করেছ? ছিঃ! 

- কাজটা আপনি ঠিক করলেন না ভবদুলালবাবু। 

- ইউ স্কাউন্ড্রেল৷ তুমি আমায় থ্রেট দিচ্ছ?

- অরিন্দম দত্তের কলজের জোর নেই আপনাকে ধমক দেওয়ার। তবে জাদুসম্রাট ননীগোপালের আছে৷ 

- গেট আউট। আই সেড গেট আউট। নয়ত দারোয়ান ডেকে তোমায় গলাধাক্কা দেব..।

- যাচ্ছি। তবে এই পোস্টারটা রেখে গেলাম আপনার টেবিলে। দু'বছর বাইশে অগস্ট আমার একটা শো আছে। তদ্দিনে নিশ্চয়ই আপনার রাগ গলে জল হয়ে যাবে। আসতেই হবে কিন্তু স্যার। আজ আমি আসি।

অরিন্দম বেরিয়ে গেলে পোস্টারটা টেবিলের ওপর থেকে তুলে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালেন ভবদুলাল৷  হলুদ কাগজের ওপর কালো কালি দিয়ে ছাপা সস্তা পোস্টারটা কেমন যেন টেনে ধরল তাঁকে। পোস্টারে আঁকা অরিন্দমের মুখ, অবশ্যই জাদুসম্রাট ননীগোপালের সাজে৷ হাড় জ্বালানো রাগ নিমেষে স্তিমিত হয়ে ভবদুলালবাবুকে বিহ্বল করে তুলল। মাথাটা যেম ঝিমঝিম করে উঠল৷ টেবিলে রাখা পোস্টার ভেদ করে তিনি স্পষ্ট দেখতে পেলেন একটা ব্যাস্ত ফুটপাথ। সে'খানে দিকভ্রান্ত অবস্থায় যে মানুষটা দাঁড়িয়ে তাঁকে চিনতে ভবদুলালবাবুর কোনও অসুবিধে হলনা।

অজ্ঞান হয়ে অফিসের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ার আগে ভবদুলালবাবু স্পষ্ট দেখতে পেলেন যে সেই ফুটপাথে দাঁড়ানো ভবদুলালের মাথার ওপর সপাটে এসে পড়ল হঠাৎ ভেঙে পড়া একটা ল্যাম্পপোস্ট। 

৩।

তেইশে অগস্ট উনিশশো বিরানব্বুইয়ের আনন্দবাজার পত্রিকার তিন নম্বর পাতাটা দেখার জন্য কতদিন মুখিয়ে ছিল অরিন্দম। 

গতকাল ভরদুপুরে উত্তর কলকাতার রাস্তায় একটি ল্যাম্পপোস্ট ভেঙে পড়ে শহরের শিল্পপতি  ভবদুলাল মিত্রের মাথায়। 

স্পটডেড।

"গিলি গিলি গে" বলে হেসে ফেলে অরিন্দম। দু'বছর খেটে এ ম্যাজিক তাকে বুনতে হয়েছে। ট্রেন বা তাজমহল গায়েব তো সে তুলনায় ছেলেখেলা।
 
আর যাই হোক, আদত জাদুকরের শ্রেষ্ঠ 'আইটেম'গুলোকে কিছুতেই জনসমক্ষে আনা চলেনা।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু