Skip to main content

আদেখলাপনা


*

বুকের মধ্যের ধুকপুকটা বড় বিশ্রী ঠেকছিল সৌভিকের।  এমনিতে সমুদ্রের হাওয়ার ঝাপটা মুখে লাগলে ভালোই লাগে ওর, কিন্তু আজ অস্বস্তি হচ্ছিল। এক ধরণের উদ্ভট ভয়। উফ, নিজেকে সত্যিই বদ্ধ পাগল বলে মনে হচ্ছিল। এর'ম উঠল বাই তো কটক যাই-য়ের কোনও মানে হয়? পুরী অবশ্য কটক থেকে তেমন দূরে নয়। কিন্তু তাই বলে ব্যাঙ্গালোর থেকে সড়ক পথে এমন দুম করে ছুটে আসার কোনও মানেই হয়না।

*

- সমীরণ রে। চল না ভাই। গোয়া যাই।

- এই আদেখলামোগুলো না করলেই নয় রে? 

- মোটেও আদেখলামো নয়। কত মানুষ গোয়া যাচ্ছে। আর আমরা প্ল্যান করলেই দোষ?

- দ্যাখ সৌভিক, দু'টো ডবল এগরোলের অর্ডার ক্যান্সেল করে একটা সিঙ্গল এগরোল চাইতে হল। সেই একটা এগরোল নিয়ে দু'জনের কামড়াকামড়ি করছি কারণ দু'জনের পকেটের সমস্ত খুচরো পয়সা জুড়ে ওই একটা এগরোলই কেনা গেছে। কাজেই বেফালতু গোয়া গোয়া শুনলে গা জ্বলে যায়।

- সিড, আকাশ, সমীর। ওরা কেমন দিব্যি ঘুরে এলো রে। আহা।

- বটেই তো। দিব্যি ইয়াব্বড় গাড়িতে উঠে ইয়াব্বড়বড় বাতেলা ঝাড়তে ঝাড়তে বাবুরা গোয়া গেল। আর সে সিনেমা দেখে কুপোকাত শ্রীসৌভিক দত্তও স্বপ্ন দেখছেন গোয়া গিয়ে ফুর্তি করার। শোন, ও'সব বাদ দে। ক্লাস ইলেভেনে আমরা দু'জনে যা রেজাল্ট বাগাচ্ছি, বরাতে গোয়া গিয়ে রোলের দোকান দেওয়া ছাড়া আর কোনও গতি নেই হয়ত।

*

হোটেলে গোল্ডেন সানরাইজের সামনে যখন সৌভিক দাঁড়ালো তখন রাত এগারোটা।  অগস্ট রাতেরর সমুদ্রের হাওয়া গায়ে লাগলে অল্প শিরশির করা উচিৎ । অথচ সৌভিক ঘামছিল। চল্লিশের আগেই বাড়তি কোলেস্টেরলের বোঝা বয়ে বেড়ালে যা হয় আর কী। আর তার ওপর এই অহেতুক হুজুগ। ধুস।

সৌভিক এ'বার অত্যন্ত বিরক্ত বোধ করলে। নিজের ওপর রাগ হল বেশ। এই ছেলেমানুষির কোনও মানে হয়? সমীরণকে এ'সব জানানোও যাবেনা, সে এক লজ্জার ব্যাপার হবে।

*

- আচ্ছা, বেশ। গোয়া না হোক। অন্তত পুরী তো যাওয়াই যায়।

- চ'না সৌভিক। তার চেয়ে বোলপুর ঘুরে আসি। সকালে যাব। বিকেলে ফেরত।

- ধেত্তেরি৷ সমীরণ। শোন। পুরীই যাব। প্ল্যানটা তো করি।

- ধুর ধুর। আমাদের ওই প্ল্যানই হবে৷ তারপর লবডঙ্কা। বাপের পয়সায় প্ল্যান করলে যা হয় আর কী।

- বাপের পয়সায় কেন। নিজেদের গ্যাঁটের পয়সা খরচ করে যাব। আরে একদিন না একদিন তো দু'জনেই চাকরী পাব নাকি।

- কবে রাম উইল বিকাম রাজা, তবে উই উইল গো টু পুরী ফর খাজা।

- আরে উঠল বাই কটক যাই তো নয়৷ শোন, আমরা নির্ঘাৎ যাব। শুধু আমি আর তুই। কালই তো যাচ্ছি না। না হয় যেতে দেরী হবে। কিন্তু যাবই।

- নাহ্। কী সিনেমাই দেখলাম রে, তোর মাথাটাই গেল বিগড়ে। আর ও'সব রহিসি ইয়ারদোস্তি সিনেমায় দেখতে ভালো।

- তা কেন? আমার মধ্যে কি সামান্য সিড আর সমীর মেশানো ইয়ে নেই? এ'দিকে তুইও দিব্যি আকাশের মত ফক্কর। 

- তোর মাথাটা গেছে। 

- বেশ৷ তবে শোন৷ আজ কত তারিখ? দশই অগস্ট দু'হাজার এক। তাই তো? দু'হাজার দশের অগস্টের মধ্যে..না। একটু তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। শোন। দু'হাজার কুড়ির দশই অগস্টের মধ্যে আমি আর তুই সমুদ্রের ধারে একসঙ্গে ফুর্তি করতে যাবই। 

- বাহ্। বেশ কম্ফর্টেবল টার্গেট নিয়েছিস।

- আমরা দু'জনে সমুদ্রের ধারের ভেজা বালিতে লেপ্টে বসে গল্প করবই।  ওই পুরীই সই। দু'হাজার কুড়ির দশই অগস্টের মধ্যে। তার আগেই হয়ে যাবে হয়ত। 

- উনিশ দিনে যা হওয়ার নয়। তা উনিশ বছরেও হবে না।

- হবেই।

- আচ্ছা সৌভিক, এ'টা দু'হাজার এক। তুই নিশ্চিত দু'হাজার কুড়িতে  আমাদের যোগাযোগ থাকবে?

- আলবাত। শোন, আমরা পুরী গেলে হোটেল গোল্ডেন সানরাইজে থাকব। চমৎকার পোজিশন। রাইট অন দ্য বীচ। গত বছর অফিসের কী একটা কনফারেন্সের জন্য মেজোমামা গিয়ে ছিল দিন দুয়েক। এলাহি ব্যাপাস্যাপার নাকি।

- পুরীর কম্প্রোমাইজটাই তা হলে রইল? গোয়ার সেই কেল্লায় বসে জাহাজ দেখা হাহুতাশ বাদ দিলি? প্ল্যান করবিই যখন, গণ্ডার মারা ভাণ্ডার লোটা লেভেল হলেই ভালো নয় কি?

- রোম্যান্টিক ইয়েকে খোঁচা দিবি রে সমীরণ? 

- তোর মধ্যে যে'টা আছে সে'টা হল আদেখলাপনা। রোম্যান্স নয়। যত্তসব। 

*

করোনার ঝাপটায় পুরীর সমস্ত হোটেলই বন্ধ। গোল্ডেন সানরাইজও তাই৷ বছর কুড়ি আগের সে এলাহি হোটেলের ভাগ্য যে এখন বেশ পড়তির দিকে তা অবশ্য সে হোটেল বাড়ির জীর্ণ চেহারা দেখলেই মালুম হয়। 

নিজেকে ঠাস ঠাস করে চড়াতে ইচ্ছে হচ্ছিল সৌভিকের৷ এ পাগলামোর কোনও মানে হয়? করোনার মত বিদঘুটে একটা ব্যাপারে তোয়াক্কা না করে দেড় হাজার মাইল ড্রাইভ করে আসা? বউ রেগে আগুন। আর এমন পাগলামো দেখলে রাগবে নাই বা কেন? 

দু'হাজার কুড়ির দশই অগস্ট পুরীর গোল্ডেন সানরাইজ হোটেলের সামনে আসতে হবেই আর এলে সমীরণের সঙ্গে দেখা হবেই। কেন যে এই অযৌক্তিক পাগলামো চেপে ধরল। সমীরণের সঙ্গে আজ বছর পাঁচেক কোনও যোগাযোগ নেই৷ অবিশ্যি ফোন নাম্বার অজানা নয়, কথা বলে নেওয়াই যেত৷ কিন্তু তবু এই পাগলামো। সমীরণ ঠিকই বলত, তার মধ্যে সত্যিই  প্রচুর পরিমাণে আদেখলাপনা জমে রয়েছে। ছিঃ ছিঃ।

লজ্জার ব্যাপার।

সমীরণকে ফোন করে এই লজ্জার কথাটা জানানো ঠিক হবে কি? বহুদিন যোগাযোগ নেই। আজ এদ্দিন পর এই পাগলামোর খবরটা জানিয়ে ফোন করলে সে ব্যাটা নিশ্চয়ই বিশ্রীভাবে হাসবে৷ আদেখলা বলে লেগপুল করতেও ছাড়বেনা। সমীরণের হাসি রীতিমতো হাড় জ্বালানো, ভেবেই শিউরে উঠক সৌভিক।

*
- হ্যা..হ্যালো!

- কী রে ইডিয়ট!

- স...স..সমীরণ!

- তোতলাচ্ছিস কেন? নাকি নাম্বারটাও ডিলিট করেছিস? তাই অমন হাতড়ে কথা বলতে হচ্ছে..।

- আমি..আমি না তোকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম..মা কালীর দিব্যি। মাইরি।

- দশই অগস্ট। টুয়েন্টি টুয়েন্টি। ফোন করার ইচ্ছেটা অস্বাভাবিক নয়। তবে তোর ওই ইচ্ছে পর্যন্তই দৌড়। ফোনটা কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমিই করলাম।

- লজ্জার মাথা খেয়েই বলি রে সমীরণ। আমার দৌড় শুধু ইচ্ছে পর্যন্ত নয়৷ জানিস, আমি বাঙ্গালোর থেকে ড্রাইভ করে পুরী ছুটে এসেছি? উন্মাদের মত মনে হচ্ছিল তুইও সারপ্রাইজ দিতে এ'খানে এসে হাজির হবি৷ দশই অগস্ট দু'হাজার কুড়ি বলে কথা। সেই, কথা মত পুরীর গোল্ডেন সানরাইজ হোটেলে...আমি ভাবলাম।

- সৌভিক।

- আমি একটা আস্ত ইডিয়ট।

- নাহ্। তুই ইডিয়ট নোস। তুই রোম্যান্টিক। 

- বাহ্। শুধরে গেছিস তুই। আমি ভাবলাম ফের আদেখলামোর খোঁটা দিবি।

- আদেখলাপনা? বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সে'টা বরং আমার বেড়েছে৷ তোকে আজ কেন ফোন করলাম জানিস সৌভিক?

- কেন?

- কেন জানি মনে হলো তোর আদেখলাপনা তোকে পুরীতে বেঁধে না রেখে গোয়ায় টেনে আনবে। আজ গোটাদিন গোয়ার এই কেল্লার আশেপাশে কাটালাম। ওই যে রে, সেই দিল চাহতা হ্যায় ফোর্ট। একাই এসেছি, এ'বাজারে ট্যুরিস্টও নেই৷ পাগলের মত মনে হচ্ছিল, যদি দুম করে তোর দেখা পেয়ে যাই।

- ফাইনাল স্কোরবোর্ড। আদেখলাপনা ওয়ান, রোম্যান্স জিরো।

- হেহ্।

Comments

SWARNENDU SAHA said…
চমৎকার স্যার।

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু