Skip to main content

হর্ন

কিছুদিন আগে এক বন্ধুর সঙ্গে লম্বা আলোচনা হল গাড়ি চালানোর সময় হর্ন বাজানোর অভ্যাস নিয়ে।

স্বাভাবিক ভাবেই আমি বলেছিলাম হর্ন যতটা সম্ভব কম বাজানো উচিৎ। সেই বন্ধুটি তাজ্জব বনে গেছিল কথাটা শুনে; ও বেশ মাথাটাথা নেড়ে বলেছিল "কমঠম আবার কী রে? হর্ন আদৌ বাজানো উচিৎ না, 'রেয়ারেস্ট অফ রেয়ার' ঘটনা বাদে। ওর মতে গাড়ি চালানো বেশ নিচু স্তরের স্কিল, সে'খানে "ডিসিশন মেকিং"য়ের কোনও সুযোগ নেই। অর্থাৎ গাড়ি চালানোয় যে কোনও কেৎই অপ্রয়োজনীয়,  মাথা খাটানোর কোনও সুযোগ ড্রাইভিংয়ে নেই। সোজাসাপটা কিছু নিয়ম, সে'গুলো মাথা নিচু করে মেনে নিয়ে 'প্লেয়িং ইন দ্য ভি'। 'স্টেপ আউট' ড্রাইভিংয়ের জগতে অদরকারী আর ক্ষতিকারক।

আর মুখ বুজে নিয়ম মেনে গাড়ি চালানোয় যে'টার আদৌ দরকার পড়ে না সে'টা হল গাড়ির হর্ন। এই যেমন গাড়ির হ্যান্ডব্রেক, গাড়িতে আছে বলেই খচাং খচাং করে যখন তখন টানতে হবে? রেয়ারেস্ট অফ রেয়ার ঘটনায় হয়ত দরকার হতে পারে। সে'রকমই; হর্ন।

বন্ধুর কথা শুনলাম। মাথা নাড়লাম। তবে চিন্তা রয়ে গেল। আমি না হয় মাথা গুঁজে নিয়ম মেনে গাড়ি চালালাম, কিন্তু অন্যেরা গায়ে এসে পড়লে? তখন তো বোধ হয় হর্ন না দিলে ঘ্যাচাং ফু! 

কলকাতায় ফিরে জয় মা বলে শুরু করলাম এক্সপেরিমেন্ট। হর্ন না বাজিয়ে কদ্দূর গাড়ি  চালানো যায়।

দিন দশেক কেটে গেছে। গাড়ি কলকাতা শহরে দেদার ঘুরেছে। এই কদিনে আমার সাতপুরনো গাড়িটা বেহালা, পার্কসার্কাস, ঢাকুরিয়া, হাজরা, ময়দান, সল্টলেক; এই সমস্ত জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছে। পুরো যাতায়াতটাই অফিস টাইমের ভিড় ঠেলে। অদ্ভুত কাণ্ড,  এই দশ দিনে তিনশো কিলোমিটার গাড়ি চালানো হল; একবারও হর্ন না বাজিয়ে। মাইরি, একবারও না।

হর্ন বাজানোর জন্য হাত নিশপিশ করেনি?

আলবাত।

সিচুয়েশন ১ - ট্রাফিক সিগনালের কাছাকাছি এসে। মনের মধ্যে নার্ভাসনেস জমা হয়। সবুজ দেখলেও স্পীড বেড়ে যায়। আগে নার্ভাস হলেই হর্ন দিতাম। অ্যাটিচিউড হল "সাবধান কুরুসেনা, আমার রথের জন্য রাস্তা ফাঁকা করে দাও। তুরন্ত"। পাশের গাড়ির হর্ন শুনে ছোঁয়াচে কাশির মত আরও হর্ন বাজাতে ইচ্ছে করত। কিন্তু। সেই বন্ধু বলেছে "গাড়ি চালানোয় ডিসিশন নেই, ইনোভেশন নেই, বি আ রোবট"। ব্যাস। টেনশন গন, নার্ভাসনেস হাওয়া। গাড়ি উড়িয়ে নিয়ে গেলেও নোবেল তো পাব না। আর সাধের গাড়ির গায়ে বাসের চুমু আর অটোর খোঁচার চেয়ে অফিস পাঁচ মিনিট লেটে ঢুকে গজরগজর শোনাও ভালো। অতএব সিগনালে সবুজ দেখলেও গতি বাড়ানোর বদলে সামান্য কম করছি। আর হলুদ দেখলে সোজা রোক্কে। ব্যাস, নার্ভাসনেস হাওয়া! নিজেকে নবরত্ন তেলের ডিবে মনে হচ্ছে ক'দিন ধরে।

সিচুয়েশন ২ - ওভারটেক। ওভারটেক খুব টেনশনের স্যার। খুব। বি-কমে নম্বর কম পাওয়ার দুঃখ দু'চারটে হুশহাশ ওভারটেক করলে কম হবে বলে মনে হয়। কিন্তু আদতে রক্তচাপ বাড়ে। মুখ দিয়ে খিস্তি বের হয়। রোখ চেপে যায়। আর অত্যধিক রক্তচাপ খুব চাপের; তা নিয়ে অফিসে ঢুকলে গোল, তা নিয়ে বাড়ি ফিরলে মেগা-কেস। অতএব? ফাঁকা গোল পেলে শট নেব, নয়ত নয়। রাস্তা পুরোপুরি ফাঁকা থাকলে তবেই ওভারটেক। যে ওভারটেকে গাঁক গাঁক করে হর্ন বাজাতে হয়, সে ওভারটেক ঝুঠা হ্যায়। আপার-ডিপার ফায়ার তবু মন্দের ভালো, হর্ন বাজিয়ে ওভারটেক মহাচাপ। আর সে'টা কোনও মারাদোনা লেভেলের স্কিলও নয়। বরং অনেকটা আঙুলের ডগায় থুতু মাখিয়ে সুইচবোর্ড ঘেঁটে পদ্মশ্রী আশা করার মত ব্যাপার।

সিচুয়েশন ৩ - আপনার চার চাকার সামনে রয়েছে রিক্সা বা সাইকেল; জিরো হর্সপাওয়া, পুরোপুরি প্যাডেলে। হর্ন দিতেই হবে?
মাইরি। না। সে সুযোগ পেলেই আপনাকে জায়গা দেবে পাশ কাটিয়ে বেরোনোর; উইদাউট হর্ন। আর সে যদি গাজোয়ারি পথ আটকাতে চায় তবে হর্ন কেন, ট্রাম্পের থেকে পরমাণু বোমার বোতাম ধার পেলেও আপনি কিস্যু করতে পারবেন না। তবে এ'খানে একটা 'রেয়ারেস্ট অফ রেয়ার' ব্যাপার ঘটতে পারে; সাইকেল বা রিক্সা চালক হয়ত প্যাডেল করতে করতে স্বপ্ন দেখছেন, আপনার উপস্থিতিই তাঁর গোচরে আসছে না। সে ক্ষেত্রে হয়ত আপনাকে হর্ন বাজাতে হতে পারে। তবে ওই, শহরের রাস্তায় তেমন হওয়ার সুযোগ খুব কম। গত তিনশো কিলোমিটারে অন্তত আমি তেমনটা দেখিনি।

সিচুয়েশন ৪ - পথচারী হাত দেখিয়ে রাস্তা পেরোচ্ছেন। গা জ্বলতে পারে। কিন্তু ওই বুদ্ধ হয়ে না হেসে উপায় নেই। রিল্যাক্স।  যারা চলন্ত গাড়ির সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পারেন, তাঁদের বাঁটুল বুকে হর্নের বুলেট হেনে লাভ নেই। ইউ ক্যান বি দ্য জলসাঘরেস্ক ছবি বিশ্বাস ইন আ ওয়ার্ল্ড ফুল অফ কেষ্ট মুখুজ্যেস। চয়েস ইস ইওর্স।

ইয়ে - আর একটা 'রেয়ার' ব্যাপার হতে পারে। খুব সরু আর/বা আঁকাবাঁকা গলিতে ঢুকে পড়েছেন, উল্টো দিক থেকে কী/কে আসছে বোঝার উপায় নেই, তেমন রাস্তায় হয়ত হর্ন দরকার হতে পারে। হয়ত।

এইবার। হর্ন না বাজিয়ে কি আমায় খুব ধীরে ড্রাইভ করতে হয়েছে? এক ঘণ্টার রাস্তায় বড় জোর পাঁচ থেকে দশ মিনিট বাড়তি সময় যোগ হয়েছে। বড়জোর।

আর সবচেয়ে জরুরী দু'টো কথা:

১। "হর্ন বাজাব না" মনস্থ করার পর থেকে আমার ড্রাইভিং বেশ শুধরেছে। ভালো বাংলায় যাকে বলে; "মাচ স্মুদার"।

২। এ'টা সব চেয়ে বড় কথা। শহুরে ড্রাইভিং-ঘটিত স্ট্রেস কমে দশ ভাগের এক ভাগে এসে ঠেকেছে। ক্লান্তি কম হচ্ছে। অফিসে ফুরফুরে মেজাজে ঢুকছি, বাড়ি ফিরছি মেজাজকে মাখনে চুবিয়ে।

আর। শহরের রাস্তা কানে যে গরম আলকাতরা ঢেলে দেয়, তার অনেকটা জুড়েই অকারণ হর্ন। অথচ হর্নবাজি দিব্যি বাদ দেওয়া সম্ভব। আমাদের দেশেও; সম্ভব।

Comments

হর্ন বন্ধ করার ওপর এমন সুন্দর একটা piece. Just too good.

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু