Skip to main content

প্যারামাউন্ট

ক্লাস ইলেভেনে ওঠার পর বুঝলাম পৃথিবীটা চটপট পালটে না ফেললেই নয়। বাবার দাড়ি কামানোর ক্ষুরটা মাঝেমধ্যেই হাতছানি দিয়ে ডাকতে শুরু করল। খবরের কাগজ ঘেঁটে 'পলিটিকাল ওপিনিওন' খুঁজে বের করে থুতনি চুলকোনোর আলগা মজা সবে টের পেতে শুরু করেছিলাম। টিউশন ফেরতা রাস্তায় মোটরসাইকেলের হুশ শুনলেই নিজের হিরো সাইকেলটার প্রতি খুনে অবজ্ঞায় মন ভার হয়ে আসত। নিজের ফুসফুসে ক্রমাগত পাতি অক্সিজেন চার্জ করছি ভাবলেই নিকোটিনিক-আত্মগ্লানিতে বালিশের ওয়াড় চিবিয়ে ফেলছি তখন। প্রেমটা দরকারি মনে হচ্ছে অথচ স্পষ্ট বুঝতে পারছি "প্রেমফ্রেম আবার কী" গোছের আঙুরফল বাক্য ছাড়া নিজের আত্মবিশ্বাসের অভাব ঢাকা অসম্ভব।

ঠিক সেই সময়। সেই টানাপোড়েনের সময়। সেই টিউশন-সন্ন্যাসের বিকেলগুলোয়; আমাদের জীবনে বোধিবৃক্ষের ছায়া নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল পাড়ার নতুন পেস্ট্রি-প্যাটিসের দোকান - প্যারামাউন্ট। সেই সময় মফস্বলে অমন বাতানুকূল কেক-প্যাটির দোকান বড় একটা ছিল না। আর সে দোকানে কেক-প্যাটিস-কোল্ডড্রিঙ্কসের বাইরে ছিল এক দেওয়াল ভর্তি গ্রিটিংস কার্ড! সেই সব গ্রিটিংস কার্ডের বেশিরভাগের গায়ে অসংখ্য দগদগে হার্টসাইন; সেকেলে মফঃস্বলি ভাষায় আমরা হুহু বুকে বলতাম 'দিল চিহ্ন'। তা বাদেও হরেকরকম ইমোশনাল সুড়ুসুড়ি দেওয়া গ্রিটিংস কার্ড। আমরা যারা গ্রিটিংস কার্ডের দুনিয়ায় ব্রাত্য ছিলাম, তারা মনের দুঃখে প্যাটিস খেতাম আর গ্রিটিংকার্ডিস্টদের "ন্যাকা" বলে গায়ের ঝাল মেটাতাম।

যা হোক। প্যারামাউন্টের প্যাটিস প্রসঙ্গে আসি। ভেজ, চিকেন আর মাটন। তিন রকমের প্যাটিস পাওয়া যেত। কৈশোরের ভুঁড়িহীনতার মতই প্যারামাউন্টে মাটন প্যাটিস এখন আর পাওয়া যায় না। কিন্তু তখন যেত। বলাই বাহুল্য; ভেজ প্যাটিস খাওয়া বারণ ছিল।

আর সে চিকেন মাটন প্যাটিসের যে কী বুক এস্পারওস্পার করা স্বাদ। হাজারটা প্রেম মরলে তবে অমন স্বাদের জন্ম হতে পারে। টাটকা, মুচমুচে মোড়কে মাটন বা চিকেনের পরিমিত মণ্ড। বাল্বের আলোর ওমে উষ্ণ সে প্যাটিস ছুরি হয়ে মনের মাখনে এসে বসত। গ্রিটিংস কার্ডগুলোকে মনে হত জুপিটারের চাঁদ; অদরকারী।  আমাদের পূর্ণিমা বলতে প্যাটিসে কামড়। মেন ওয়াকড ইনটু দ্য বার, উই হ্যাড প্যারামাউন্ট টু ওয়াক ইনটু।

তবু। মাঝেমধ্যে দীর্ঘশ্বাস উঁকি দিত। এক শীতের সন্ধ্যের গরম মাটন প্যাটিসের দ্বিতীয় পেগে কামড় বসাতে বসাতে আমার ক্লাসমেট সঞ্জুর চোখ আটকে গেছিল আসমানি রঙের একটা গ্রিটিংস কার্ডে, সে কার্ডের সামনে নাম না জানা লাল পাখির স্কেচ। হ্যাপি বার্থডে লেখা কার্ড।

"কার্ডটা বড় ভালো রে", সঞ্জুর গলায় অ-প্যাটিসিও গাম্ভীর্য এসে পড়েছিল, "নীল রঙটা বড় প্লেজ্যান্ট। সুদিং। মন কেমন করা। সেকশন বি'র মুনমুনের মত। মুনমুনের জন্মদিন পরশু। এই কার্ডটা যেন ওর জন্যই তৈরি। শুধু ওর জন্য। কিন্তু আমি মুনমুনকে কার্ড দেব? আমি? মুনমুন জোড়া চাঁদ হলে আমি দু'মাথা ময়লা ইয়ারবাড। মুনমুন কবিতা হলে আমি বিড়ির প্যাকেট মোড়া হলুদ ছাপা কাগজ। মুনমুন অস্ট্রেলিয়ার ডন ব্র‍্যাডম্যান হলে আমি তুলসী চক্রবর্তীর ডন বৈঠক।  আমি দেব মুনমুনকে কার্ড? ছোহ্"।
সঞ্জুর দুঃখে সে'দিন বাড়তি এক জোড়া প্যাটিস খেয়ে তবে বেরিয়েছিলাম।

সে ঘটনার দেড় মাসের মাথায় সঞ্জুর সঙ্গে ফের গেছিলাম প্যারামাউন্টে জোড়া মাটন প্যাটিস খেতে। সঞ্জুই খাইয়েছিল। খাওয়ানোর কারণটা জেনেছিলাম দু'নম্বর প্যাটিসে কামড় বসিয়ে। সঞ্জুর জন্মদিন ছিল তিন দিন পর। সে'দিন সকালেই ক্লাসের ফাঁকে নাকি কবিতা/চাঁদের পক্ষ থেকে বিড়ির প্যাকেট/ইয়ারবাডের নামে গোপন আগাম-শুভেচ্ছাবার্তা এসেছিল। আসমানি নীল রঙের কার্ডে, যার সামনে অচেনা লাল পাখির স্কেচ।

"প্যারামাউন্টের গ্রিটিংস কার্ড আমার স্কুল ব্যাগে রে। আমার নামে লেখা কার্ড। সেই কার্ড। লাল খামে। আমার মত অঙ্কে বাইশ পাইয়ের ব্যাগে। মুনমুনের লেখা কার্ড। আমার ব্যাগে। অ্যাচিভমেন্ট আনলকড। আমি ফ্যান্টমের আংটি, তুই ভাঙা টুথপিক। আমি বিলির বুট, তুই অনিমেষ স্যারের নস্যি মাখানো রুমাল। আর একটা প্যাটিস খাবি ভাই"?

সেই প্রথম প্যারামাউন্টের মটন প্যাটিস তেতো মনে হয়েছিল। গলা বুক জ্বালা শুরু হয়েছিল। সঞ্জুকে "ন্যাকামির ডিপো" বলে গাল পেড়ে, আধখাওয়া প্যাটিস ঠোঙায় পুরে সুট্ করে বেরিয়ে এসেছিলাম প্যারামাউন্ট থেকে।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু