Skip to main content

বিপিনবাবুর সকাল



বিপিনবাবু দু’টো ফুলের টবের মাঝে পড়েছিলেন। পিছমোড়া করে বাঁধা। বাঁধনে ধার ছিল, দড়িটা পিঠে কোমরে বসে গেছে। জ্বালা করছে। যত্ন করে বিপিনবাবুকে এখানে শুইয়ে দেওয়া হয়নি সে’টা বোঝাই যাচ্ছে। রীতিমত ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে এই ব্যালকনিতে। কপালে চোট লেগেছে। কেটে যায়নি তবে ফুলে নীল। কনুইয়েও লেগেছে তবে সামান্য। মুখের মধ্যে ন্যাকরা ঠুসে দেওয়া, টু শব্দ করতে পারছেন না তিনি। সাদা পাঞ্জাবি আর পাজামায় ধুলো ময়লা মাটি লেগে একাকার।  

ব্যাপারটা নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। দম বন্ধ করা যন্ত্রণা; যতক্ষণ পড়ে থাকা ততক্ষণ। ঘণ্টাখানেকের আগে ব্যালকনিতে কেউ আসবে না। কারুর নজরে পড়বে না বিপিনবাবুর হেনস্থা। 

মনে মনে নামতা পড়ার চেষ্টা শুরু করলেন বিপিন বসু। তেরোর ঘর পেরিয়ে গেলে শুরু করলেন গুনগুন; মনে মনে – মন দিল না বঁধু। গুনগুন অবিশ্যি বেশি দূর এগোতে পারে না। খান কয়েক চড়াই এসে তার ওপর চড়াও হল বেফিকির; ওরা বুঝতে পারে বিপিনবাবু এখন নো নড়ন চড়ন জোনে। চড়াইয়ের ঠুকঠুকে বিরক্ত হলেও, বিপিনবাবু ভেবে মজা পেলেন যে চড়াই এখনও আসে। এসে দু’দণ্ড ব্যালকনিতে বসে। বিপিনবাবু বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে নিউটাউন চড়াই-লেস্‌ হয়ে গেছে। আশ্বাস হল; ভোরের শহরে এরা এখনও আছে।

হাতে হাতঘড়ি আছে, কিন্তু তা দেখার উপায় নেই। শুধু আকাশের আবছায়া দেখে বোঝা যাচ্ছে যে নিশ্চই ছ’টা বাজেনি। অর্থাৎ এখনও ঘণ্টা দেড়েক সহ্য করা। রাস্তায় গাড়িঘোড়ার চলাচলও বিশেষ শুরু হয়নি। ফ্ল্যাটবাড়ির ঠিক নিচে লাগোয়া অনিলের চায়ের দোকান। সেখানে হাই কোয়ালিটি ঘুগনিও পাওয়া যায়। দিব্যি সেখান থেকে অনিলের হাঁকডাক আর গামলা মাজার আওয়াজ ভেসে আসছিল; ঘসর ঘস্‌ ঘসর ঘস্‌ ঘসসস্‌। অনিলের বৌ বাসন মাজছে। অনিলের বৌ ভালো মেয়ে। অনিল কেমন কাঠখোট্টা। অনিলের বৌ বানায় ঘুগনি। অনিল চা বানায় আর ক্যাশবাক্স সামলায়।

আজ গিয়ে খেয়াল হল যে ব্যালকনিটা কদ্দিন ভালো করে পোছা হয় না; মোজাইকে কালচে দাগ পড়ে গেছে। সবিতা বড্ড কাজে ফাঁকি দেয়। ওদিকে মাথার টনটনটা ক্রমশ বাড়ছিল। নতুন করে গুনগুনে ভেড়ার চেষ্টা করলেন তিনি; “স্বপ্নে দেখি একটি নূতন ঘর; তুমি আমি দু’জন, তুমি আমি দু’জন প্রিয়, তুমি আমি দু’জন”। মনটা নড়েচড়ে উঠলো। আহা! কী সুর। একই গুনগুন চালিয়ে গেলেন ঝরঝর করে; ““স্বপ্নে দেখি একটি নূতন ঘর; তুমি আমি দু’জন, তুমি আমি দু’জন প্রিয়, তুমি আমি দু’জন, বাহিরে বকুল-বনে কুহু পাপিয়া করে কুজন”। 

মাথার টনটনটাকে একটু বেপথে চালান করে মনে মনে গুনগুনে এগিয়ে গেলেন বিপিনবাবু; "পূর্ণিমা চাঁদ কয়, গান আর সুর, চঞ্চল ওরা দু’জন; প্রেম-জ্যোতি আনন্দ-আঁখিজল, ছল ছল ওরা দু’জন – তুমি আমি দু’জন প্রিয় তুমি আমি দু’জন"।

সময় কীভাবে ফোঁটা ফোঁটা ঝরে পড়ে টের পাওয়া যায় না। মনের এদিক সেদিক সবে যখন সয়ে এসেছে তখনই খট করে শব্দ হল ব্যালকনির দরজায়। 

খবরের কাগজ দরজা খুলে বেরিয়ে এসে বিপিনবাবুর বাঁধন খুলে তাকে মেলে ধরলে ব্যালকনিতে রাখা বেতের সেন্টার টেবিলে।  

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু