Skip to main content

দীপু, দাদু ও নজরুল

শহরে সোঁদা গন্ধ বইয়ের মলাটের মাঝে থাকে। এখানে ছাতের সিমেন্ট-মেঝের শ্যাওলায় বৃষ্টি মিশে যে সুবাস গুঁড়ো হয়ে বাতাসে ওড়ে; তাকে চিনেতে হয়, জাপটে ধরতে হয়।

বৃষ্টিভেজা রাতের গামছায় গা মুছে নেমে আসা ভোরের ছাদে; দীপুকুমার উঠতেন দাদুর হাত ধরে। 
ছাদের উত্তর কোণে  খান চারেক টবে নয়নতারার ভিড়; তাদের পাপড়িতে টুপটুপে জল। ফ্যাকাসে খয়েরী আকাশ টলটল করতো। দাদুর ধবধবে ফতুয়ার ওপর বাটিক ছাপার পাতলা চাদর জড়ানো, ধুতি লুঙ্গির মত করে পরা। দাদুর চোখে নরম হাসি; চিরকালের। মানুষটা বকতে শেখেননি, টেবিল চাপড়াতে শেখেননি। নয়নতারাদের গালে এমনভাবে হাত বুলিয়ে দিতেন; তাদেরও আরাম হত বুঝি। তখনও দীপুবাবু হাফ প্যান্টে, তখনও দীপুবাবুর হাত দাদুর হাতে। 

ভোর ঘাসের মত জড়িয়ে ধরতো তাদের দু'জনকে; ভালোবাসা ঝিরঝির করতো ভোরের বৃষ্টিমাখা মিহি হাওয়ার তালে তালে। দাদু বলতেন এ সময়টা ভৈরবীর, ছাতের পাঁচিলে ঠুকতেন দাদ্‌রা। 
"দাদুভাই, একদিন যখন অনেক বড় হবে তখন দেখবে; নজরুল হিসেবের বাইরে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন। এই ধর চায়ের কাপের পাশে বা ভাঁজ করে রাখা গল্পের বইয়ের শিয়রে। সেদিন আর অঙ্ক কষে তাকে পাশে সরিয়ে রাখতে পারবে না। সে'দিন সাবমিশন। বুঝলে দীপুবাবু? সে'দিন ভালোবাসা"। 

দীপু ঠাহর করতে পারতো না। সে অপেক্ষায় রইত। এই বুঝি দাদু গুণগুণ শুরু করবেন; 

"তুমি আমার সকালবেলার সুর
হৃদয় অলস–উদাস–করা অশ্রু ভারাতুর"।

ভোরের নীলচে আলো ঘন হয়ে আসতো। কিচিরমিচির ভেসে আসতো ইতিউতি। দাদু দীপুর হাত ছেড়ে দিয়ে হাত রাখতেন দীপুর কাঁধে। 

নজরুল ভোরের পোস্টকার্ডে ঘষঘষ করে ঠিকানা লিখতে শুরু করতেন। দাদু এগিয়ে যেতেন। 

"ভোরের তারার মত তোমার সজল চাওয়ায়,
ভালোবাসার চেয়ে সে যে কান্না পাওয়ায়
রাত্রি–শেষের চাঁদ তুমি গো বিদায়–বিধুর"।

ভৈরবীর সমঝদার হবে দীপু? তাহলেই হয়েছে। সে বয়েসেই তার বারবার মনে হত এ গান রাতের, দাদু যেন সে গানকে হাত ধরে ভোরের ছাদে টেনে এনেছেন। 

"শিশির–নাওয়া শুভ্র–শুচি পূজারিণীর তুল।
অরুণ তুমি, তরুণ তুমি, করুণ তারও চেয়ে
হাসির দেশে তুমি যেন বিষাদ–লোকের মেয়ে
তুমি ইন্দ্র–সভার মৌন–বীণা নীরব নূপুর"। 

"বিষাদ-লোকের মেয়ে"; দীপুর মনে মনে আউড়ে নেওয়ার চেষ্টা করতো বারবার। দীপু ভোরের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে থাকা রাতের গল্পটুকু শুষে নেওয়ার চেষ্টা করতো। বারবার।

দাদুর ভোর নিয়ে চলে গেছেন। দীপু রাতের পরতে পরতে বেড়েছে। চিনেছে। রাতের বৃষ্টির ছলছল ছুঁয়ে দেখেছে। কিন্তু সমস্ত ছাড়িয়ে নজরুল হিসেবের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, ঠিক যেমন ভাবে দাদু বলেছিলো। স্নেহে, অতর্কিতে। 
স্কুল পেরিয়ে যেদিন কলেজ-ছোঁয়ানো-চুমু জড়িয়ে ছিলে মেঘলা আকাশ আর ছাদের অন্ধকারে;  কোথা থেকে যেন নজরুল আগলে ধরেছিলেন কিচিকে। কিচির চোখ ভরিয়ে এসেছিলেন নজরুল, দীপুর বুকে ছ্যাঁত ছুঁইয়ে ঝুপ করে নেমে এসেছিলে "বিষাদ-লোকের-মেয়ে"।    

দীপু নয়নতারার পাপড়ি উপচে পড়া টলটলে বৃষ্টি দানা দেখেছিল। দীপু কিচির কাঁপুনিতে সোঁদা গন্ধ খুঁজে পেয়েছিল। 


Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু