Skip to main content

পাঠক গুলজার

আমরা যারা 'ভোর্যেশাস রীডার' নই, অথচ বই ভালোবাসি; তারা যেন ঘাবড়ে না যাই। বই দেখলেই হয়ত আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি না, কিন্তু আলতো মলাট-স্পর্শকে ধুরছাই-কুছভিনহি বলে যারা নস্যাৎ করে থাকেন, তাদের মতামতকে তোল্লাই দিয়ে নিজেদের ক্রমাগত ইমোশনাল-ঝ্যাঁটাপেটা করার কোনও মানেই হয়না। আড়াই বছর আগে কেনা বই এখনও পড়া হয়নি, সে'টাকে শুধুই ব্যর্থতা বলে যারা দেখলেন, তাঁরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল আউটপুটটুকুতেই নিজেদের আটকে রাখলেন। রোম্যান্স কোশেন্টকে বুঝে উঠতে পারলেন না। সব প্রেমই যদি টপাটপ ছাদনাতলায় গিয়ে পড়ত, তা'হলে কি গজলের দুনিয়াটা এমন রঙিন হত?
আড়াই বছর আগে কেনা একটা বই, যে'টা আজও পড়ে ওঠা হয়নি; সে'টাকে একটা প্রবল সম্ভাবনার উৎস হিসেবে দেখতে হবে। বইয়ের তাকে বোকাসোকা হয়ে পড়ে আছে; ফুলদানির বা আমাজনের ফাঁকা বাক্সের আড়ালে ঢাকা পড়ছে, ঠিক আছে। কিন্তু দেখবেন; স্যাট করে যে'কোনও একদিন নামিয়েই ফ্যাট করে পড়া শুরু করে দেব। এই যে একটা দুর্দান্ত "পুজো আসছে পুজো আসছে" ব্যাপার, সে'টাকে উড়িয়ে দিলেই হবে নাকি। হঠাৎ একদিন বইয়ের তাক থেকে পুরনো না-পড়া বই নামিয়ে আনা হবে। ধুলো ঝেড়ে মলাটে হাত বুলনো হবে, ওজনটা অনুভব করা হবে, পাতাগুলো ফরফরিয়ে দেখা হবে খানিকক্ষণ। তবেই না আসল খেল্‌। আর তারপর সে বই হাতে খাটে বা সোফায় গা এলিয়ে বসা। বইটা কেনার মুহূর্তটা মনে করে একটা তৃপ্তির হাসি জেনারেট করার চেষ্টা করা। বছর-খানেক আগে কেনা বই হলে সে বইয়ের ছাপা দাম দেখে অবশ্যই একবার মনে হবে, "উফ, ইনফ্লেশন কোথায় গিয়ে ঠেকেছে রে ভাই"। এরপর, সেই বইয়ের প্রথম প্যারাগ্রাফের (বা প্রথম লাইনের) প্রতিটা শব্দ, তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা। সাদা কাগজে কালো ছাপা অক্ষর, এক এক পিস মুক্তো। দেখুন, বইয়ের ভালো-মন্দ, তা পরে আসে। সে শুচিবাইয়ের আগে আসে অন্য আনন্দ; একটা ছাপা শব্দ থেকে অন্য ছাপা শব্দে গড়িয়ে যাওয়ার। সে এক হাইক্লাস থেরাপি। ছেলেবেলা থেকেই দেখেছি; সিলেবাসে নেই এমন যে কোনও বই পড়ার মধ্যেই একটা গোবেচারা বিপ্লব রয়েছে। বইটা কেমন ভাবে পড়লাম, কতটা মন দিয়ে পড়লাম, কতটা যত্ন করে আত্মস্থ করলাম; সে'টা বাছবিচার করতে চেয়ে কেউ কোশ্চেনপেপার ধরিয়ে দেবে না। এ'টাই আমার কাছে বরাবর একটা ম্যাজিকের মত মনে হত। মার্কশিটের বাইরেও একটা পড়াশোনার জগত তা'হলে আছে যে'খানে আমার মত এলেবেলে মানুষও মাস্তানি করতে পারে। সেই জাদু-জগতের বইগুলোকে আমি গোগ্রাসে গিলব না চেটেচেটে ধীরেসুস্থে খাবো; সে'টা আমিই ঠিক করে নেব। তেমনটাই হওয়া দরকার।
তা, হয়ত সেই নতুন বইয়ের প্রথম কয়েক লাইন পড়ার পরই মনের মধ্যে একটা তৃপ্তির ঝিম লেগে গেল। তারপর বাড়ির মধ্যে যে'খানেই ঘুরঘুর করছি, হাতে বইটা ঝুলছে। পড়ছি না, কিন্তু হাতছাড়া করছি না। সোফার পাশের টেবিলে, বিছানায় বালিশের পাশে, কাজের টেবিলে ল্যাপটপের গায়ে; বই-বাবাজীটি আছেন। কিলো কিলো পড়লেই হল নাকি, রসিয়ে বইটাকে ভোগ করতে হবে তো। এ'ভাবে হয়ত এক হপ্তায় বইটা বড়জোর বিশ-তিরিশ পাতা এগোল। তদ্দিনে বইটার সঙ্গে একটা মাইডিয়ার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। সম্পর্কটা বেশ, ইয়ে, শারীরিক। লেখকের গুণ, সাহিত্য-মান; সে'সব নিয়ে পরে ভাবলেও হবে। কিন্তু প্রথম ক'দিনে বইটার গন্ধ, স্পর্শ, জ্যাকেটের ঘষটানি; সমস্ত চেনা হয়ে গেছে; সেই চেনার দাম লাখ-টাকা। যা হোক, হপ্তা-খানেক পর হয়ত সে বই চালান হবে অফিসের ব্যাগে। লাঞ্চের সময় টিফিন কৌটোর পাশাপাশি টেবিল আলো করে বেরিয়ে আসবে সেই বই। ফের এগোবে দু'পাতা-তিন পাতা করে। সে দু'পাতার অক্সিজেনেই অফিস গুলজার হয়ে উঠবে। ডেলিপ্যাসেঞ্জারির ক্ষেত্রে হয়ত সে বই বেরিয়ে আসবে বাসে-ট্রেনে-ট্রামে, মোবাইল ফোন আর ইয়ার-ফোনের সঙ্গে কম্পিটিশনে নামবে। পড়া হয়ত কয়েক লাইনের বেশি এগোবে না। কিন্তু সেই প্রতিটি লাইন পড়ার দামই ভরিতে মাপতে হবে।
এই'ভাবে। চিকনের মিহি সেলাই যে'ভাবে শম্বুক-গতিতে এগোয়, সে'ভাবে আমাদের মত অলস পাঠকের এ পাতা থেকে ও'পাতায় এগিয়ে যাওয়া। পৌষের শীতে শুরু হওয়া বই যখন জ্যৈষ্ঠের ভ্যাপসা গরমে শেষ পরিচ্ছেদে এসে দাঁড়াবে, পাঠক ততক্ষণে শিল্পীতে পরিণত হয়েছেন। তিনদিন বুক চিতিয়ে মিনিমাম স্ট্রাইকরেটে ব্যাটিং করে দলকে টেস্ট জেতানোর আনন্দ তখন তাঁর হাতের মুঠোয়।
কাজেই আমরা যারা ঢিমেতালে বই পড়ি, তাঁদের পাঠককুলের কলঙ্ক বলে পাশ কাটিয়ে দেবেন না। কেমন?

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

ব্লগ-বাজ

আর চিন্তা নেই । বাঙালিকে আর রোখা যাবে না । আর সামান্য (সম্ভবত কিঞ্চিত গোলমেলে ) কবিতা ছাপাবার জন্যে সম্পাদক কে তোল্লাই দিতে হবে না । আর প্রেমে লটরপটর হয়ে ডায়েরি লিখে প্রাণপাত করতে হবে না। পলিটিক্স কে পাবলিক-জন্ডিস বলে গাল দেওয়ার জন্য আর “প্রিয় সম্পাদক” বলে আনন্দবাজারের ঠ্যাং ধরতে হবে না। কেন ?  হোয়াই? বাঙালি ব্লগিং শিখে গ্যাছে যে। ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে শাণিত তলোয়ারের মত “ পোস্ট”-সমূহ জনতার ইন্টেলেক্ট এসপার-ওসপার করে দেবে ; হাতে-গরম গায়ে-কাঁটা। বাঙালি মননের নব্য জিস্পট ; ব্লগ-স্পট । কে বলে যে বাঙালি ব্রিগেডে বুক্তুনি দিয়ে আর ফুটবল মাঠে খেউড় করে খতম হয়ে গ্যাছে ? কে বলে যে বাঙালির ঘিলু কফি হাউসে ভাত ঘুমে মগ্ন ? বাঙালিকে একবার ব্লগখোর হতে দিন , সমস্ত অভিযোগ ভ্যানিশ হয়ে যাবে । পোপ থেকে পরশুরাম ; ডেঙ্গু থেকে মশাগ্রাম ; বং-ব্লগের দাপট রইবে সর্বত্র । বাঙালির সমস্ত আশা-ভরসা-জিজ্ঞাসা এইবারে ব্লগ মারফত্‍ পৌছে যাবে ট্যাংরা ট্যু টেক্সাস । তোপসে মাছের স্প্যানিশ ঝোলের রেসিপি কী ? বাঙাল-ঘটি মিল মহব্বত-হয়ে গেলে কি বাঙ্গালিয়ানা চটকে যাবে ? নেতাজী কি এখ

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু