- এ'দিক ও'দিক কিছু চেষ্টা করবেন না সেনবাবু।
- আপনি কিন্তু খামোখা এতটা রিস্ক নিচ্ছেন স্যার। আজকাল দোকানের ক্যাশবাক্সে অতি সামান্যই টাকা পয়সা থাকে। সবই তো অনলাইন ট্রান্স্যাকশন। অবিশ্যি মিষ্টির ট্রে কয়েকটা নিয়ে সরে পড়তে চাইলে..।
- বড্ড বাজে কথা বলার অভ্যাস আপনার।
- বন্দুকের নলের সামনে..বড্ড নার্ভাস বোধ করছি স্যার। তাই মুখে লাগাম দিতে পারছি না..প্লীজ ডোন্ট মাইন্ড।
- ঝড়বৃষ্টির রাত। প্রায় এগারোটা বাজে। এলাকায় সমস্তদোকানপাট বন্ধ। আপনার দোকানটা খুলে রেখেছেন কেন?
- ওহ। তা'তে আপনার খারাপ লেগেছে বুঝি? আমি এখুনি শাটার নামিয়ে দিচ্ছি। এখুনি। আসলে আমি একা মানুষ। দোকানটাই আমার সংসার। কাজেই..।
- ফের বাজে কথা।
- আপনার কী চাই যদি..। ইয়ে, আপনি আমার নামটা কী'ভাবে জানলেন?
- সেন সুইটসের ক্যাশবাক্সের সামনে যে রোয়াব নিয়ে বসে আছেন, আন্দাজ করলাম আপনিই মালিক।
- ভেরি গুড অবজার্ভেশন। আমি কি একটা প্রশ্ন করতে পারি?
- পারেন।
- রিভলভার নিয়ে যারা দোকানবাজারে চড়াও হয়, তারা তো মুখ ঢেকে রাখে মাস্কে। আপনি তো..।
- আমি আপনার ক্যাশবাক্স হাতাতে আসিনি। আমার রাত কাটানোর একটা জায়গা দরকার।
- ওহ। ইয়ে, পুলিশ তাড়া করেছে?
- গুণ্ডার দলও তো আমায় তাড়া করতে পারে? নাকি আমার চেহারার মধ্যেও একটা অসামাজিক ব্যাপার আছে?
- আপনার হাতের অস্ত্রটি তো খাটি দিশি। লাইসেন্স আছে বলে মনে হয় না। তা'ছাড়া গুণ্ডাদের থেকে আপনাকে আমি প্রটেক্ট করতে পারবো কেন। কিন্তু হ্যাঁ, পুলিশ যদি আপনার খোঁজে এ'দিকে এসে পড়ে আর একজন ভদ্রলোক ব্যবসায়ী যদি সাফাই গেয়ে দেয়, আপনি একটা রাতের জন্য বেঁচে যাবেন।
- আপনি সত্যিই বড্ড বাজে কথা বলেন। শাটারটা নামিয়ে দিন দেখি।
- হ্যাঁ। এই দিই। এই..এই যে। এ'বার নিশ্চিন্ত? এ'বার অন্তত পিস্তলটা নামান। আমি এমনিতেও বৃদ্ধ মানুষ। হাতাহাতিতেও এঁটে উঠবো না।
- ভোরের আলো ফোটার আগেই আমি বেরিয়ে যাবো। পুলিশ সম্ভবত এ'দিকে ঘেঁষবে না। যদি আসে..আমি ওই দেরাজের আড়ালে থাকবো। তাঁরা সার্চ যাতে না করে, সে'টা দেখার দায়িত্ব আপনার।
- পুলিশ দোকান পর্যন্ত এলে আপনি কিন্তু আমার মার্সিতে পড়ে যাবেন।
- একদম বাজে কথা নয়। আবার পিস্তল তাক করে বসতে চাই না।
- পুলিশ যদি আসে তখন দেখা যাবে। বলছিলাম, রাতে তো আজ তাহলে আমিও এ'খানেই আছি। দোকানে চায়ের ব্যবস্থা আছে, কিন্তু আমার স্যাঙাৎটি আপাতত নেই। আর আমার হাঁটুতে বাতের মারাত্মক ব্যথা, দু'মিনিটের বেশি দাঁড়াতে পারিনা। তাই তোমাকেই বানিয়ে নিতে হবে। আর ইয়ে, তার আগে বরং তোমার দু'টো জলভরা খাওয়াই। ফ্রেশ। রাত আটটার পর তৈরি।
- চুপচাপ ওই চেয়ারেই গা এলিয়ে শুয়ে পড়ুন। বাড়াবাড়ি করতে যাবেন না।
- একটা কথা বলবো?
- আপনার কথা এখনও শেষ হয়নি?
- প্লীজ?
- বলুন।
- দু'টো জলভরা খাও। কেমন?
- আপনি আমায় চিনতে পেরেছেন সেনকাকু?
- তুমি জানতে আমি তোমায় ঠিক চিনতে পারবো।
- সম্ভবত। এই শিমুলতলা বাজারে আপনার চেয়ে সৎ ব্যবসায়ী আর কেউ নেই। আপনার সত্যনিষ্ঠার কথা গোটা পাড়ায় সবাই এককথায় স্বীকার করে। অতএব এ'বার নিশ্চয়ই পুলিশে খবর দেবেন?
- তুমি যে গুলি চালাবে না সে'টাও বেশ বুঝছি। দিই দু'টো জলভরা তপু? কী, তোমার নাম তপু তো?
- আপনি পুলিশে খবর দিচ্ছেন না কেন?
- ছোটবেলায় জলভরা চাইতে রোজ রাতে আমার কাছে, মনে আছে?
- হুম।
- এই আমি। মাধব সেন। প্রবল ভাবে অনেস্ট। বাজারেই তো মানুষের মুখে মুখে ঘোরে; "সেনবাবু দেবতুল্য মানুষ"। অথচ দেবতা হওয়ার মধ্যে কী প্রবল জ্বালা দ্যাখো। একটি বছর দশেকের বাপ-মা মরা ছেলে খিদের টানে সামান্য দু'টো মিষ্টি চাইতো রোজ রাতে। আমি তাকে ক্যারেক্টার বিল্ড করার ভাঁওতা দিয়ে বোঝাতাম গতর থাকতে ভিক্ষে করবি কেন। তোমায় দিয়ে আমার প্রতিদিনের চায়ের বাসনপত্র মাজিয়ে নিতাম, তবে দিতাম একজোড়া জলভরা সন্দেশ। অনেস্টির অহঙ্কার বড় বিষাক্ত তপু। বিশেষত অসহায় মানুষকে সততার জ্ঞানে সেঁকে নেওয়ায় যে কী তৃপ্তি! যাক গে, আমার মত পাথুরে ভালোমানুষদের খপ্পরে না পড়লে হয়তো তোমায় আজ দিশি বন্দুক হাতে পালিয়ে বেড়াতে হতো না।
***
শেষের কথাগুলো বিড়বিড়িয়ে বলে যাচ্ছিলেন মাধব সেন। বৃদ্ধের চোখ ঝাপসা; তাই তিনি খেয়াল করেননি যে নি:শব্দে কখন যেন বন্দুকটাকে কাচের শোকেসের ওপর ফেলে রেখে চায়ের বাসনপত্র ধুতে শুরু করেছে বেয়াদপ বখে যাওয়া তপু।