Skip to main content

নাগরদোলা



হুড়মুড়, হইহল্লা, আলো ঝলমল; মেলার সন্ধ্যে যেমনটা হয় আর কী৷ অঙ্ক টিউশনের গুমোট কাটিয়ে একদল ছেলেমেয়ে সেই মফস্বলি মেলা চষে বেড়াচ্ছে৷ ঢাউস খানতিনেক চপের দোকান, সে'খানে সবচেয়ে সস্তা এবং হাই-সেলিং আইটেম হল আলুর চপ৷ ছাত্রসমাজে আলুর চপের ভূমিকা নিয়ে রীতিমত এস্যে লিখতে পারে অনি৷ কিন্তু ক্লাস টুয়েলভের ছাত্রেদের সে'সব জরুরী বিষয়ে ভাবতে শেখায়না সিলেবাস৷
হাওয়াই মিঠাইয়ের চিনিগোলা ব্যাপারটা অনির তেমন পছন্দ নয়, কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে হাওয়াই মিঠাই হাতে খানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি না করলে মেলা আলুনি হয়ে পড়ে৷ সে ব্যাপারটা প্রায় ডিসিপ্লিনের পর্যায় পড়ে৷ এ'ছাড়া রয়েছে বন্দুকবাজি, বেলুন ওড়ানোর হুল্লোড়৷ সস্তা মনকাড়া জিনিসপাতির দোকানও অজস্র, সে'গুলো ঘুরে দেখাটাও গুরুদায়িত্ব৷ তবে আলুর চপ আর বন্দুকে উজাড় হয়ে যাওয়ার পর আর টিউশনফেরত ছেলেমেয়েদের তেমন কিছু কেনাকাটির দম থাকে না৷ বড়জোর দু'একটা পোস্টার, সস্তা ম্যাজিকের রসদ৷ আর সামান্য কিছুটাকা বাঁচিয়ে না রাখলেই নয়; মেলার স্লগওভারঃ নাগরদোলা৷
টিউশনির ব্যাচের সকলেই নাগরদোলায় চড়বে৷ ঢাউস একখানা চাকায় খানকয়েক টিনের আলখাল্লা বাক্স ঝোলানো। দোলা ঘুরবে, বাক্সগুলো মচমচ করে দুলবে৷ চলন্ত বাসের জানালায় কনুই রেখে বাপ-মায়ের ধমক খাওয়া ছেলেমেয়েরা এই খতরনাক চাকায় ঘুরপাক খেয়ে ফুর্তি করে৷ তবে অনির ব্যাপারটা আলাদা। ট্রেনের আপার বার্থে উঠতে গেলে তার বুক কাঁপে, রেলিং ছাড়া সিঁড়ি দেখলে গলা শুকিয়ে আসে৷ কাজেই নাগরদোলা অনির ধাতে সয়না৷
কিন্তু সে'দিনকার ব্যাপারটা আলাদা। সস্তা রেক্সিনের মানিব্যাগে রাখা শেষ দশটাকার নোটখানা বের করে টিকিট কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেছিল অনি। কারণ তেমনটাই কথা ছিল।
- অনি! তুই এমন কাঠ হয়ে বসে আছিস কেন?
- কাঠ? ক..কই না তো দিব্যি তো। রি..রিল্যাক্স করছি।
- তোর ভয় করছে।
- ধ..ধুস। আসলে..এ'ভাবে বসলে ইকুলিব্রিয়ামটা নষ্ট হবে না। তাই।
- তোর গলা কাঁপছে।
- ন..না রে ঝুমি। খুব হাওয়া তো। খুব। প্লাস এই মুভমেন্টটা..সব মিলে তোর কানের মধ্যে যে ভাইব্রেশন হচ্ছে..।
- আর এই যে...তোর হাত বরফের মত ঠাণ্ডা..।
- হা..হাত?
- বরফের মত।
- ও। ও আমার বডি টেম্পারেচার একটু..একটু..কমের দিকে। থার্মোমিটারে নিরানব্বুই মানে..মানে আমার ধুম জ্বর।
- তুই ভালো করে চোখ খুলতে পারছিস না অনি।
- ম..মিঠে..মিঠে হাওয়া..আরামে চোখ বুজে আসছে..।
- তোর মুখ শুকিয়ে গেছে। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। ঠিক করে তাকাতে পারছিস না। থামাতে বলব? চিৎকার করলেই হবে।
- ধ..ধুর..আমি তো ভাবছিলাম..আরও বার চারেক ঘুরব।
- এত ভয় যখন নাগরদোলায় উঠতে গেলি কেন?
- ভয়? ছোহ্! আমি..আমি দাবা খেলতে পারি এ'খানে বসে..ই..ইজি।
- তুই এত বড় গাধা কেন রে?
**
"অনি। কেমন আছিস?"
এই ফোনটা ছ'মাসে ন'মাসে একবার আসে অনির মোবাইলে। অফিস মিটিং, ডাক্তারের চেম্বার, বাজারঘাট; যে'খানেই থাক সে ফোন অনি ধরবেই। অবশ্য কথা বেশি দূর এগোয় না৷ কিন্তু বছর কুড়ি আগের সেই পাড়ার মেলার গন্ধ নাকে এসে ঠেকে; হাওয়াই মিঠাই, আলুর চপ মেশানো।
এই ফোনটা এলেই নাগরদোলায় বসা ধুকপুক ফেরত আসে। অনি টের পায় নিজের হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।
তবে ভয়ের চোটে ঝুমির হাত টেনে ধরা আর নেই।
আছে শুধু অনির গলা-বুক শুকিয়ে যাওয়াটা।
আর আছে অনির তলপেট ফাঁকা হয়ে কথা বন্ধ হয়ে যাওয়াটা।
আরও একটা ব্যাপার উবে যায়নি। ফোন রাখার আগে ও'পাশ থেকে ভেসে আসা চাপা ধমকঃ "তুই এত বড় গাধা কেন রে"?
**
- অনি, আজ টিউশনির পর সবাই মিলে মেলায় যাব। তুই যাবি তো?
- সদাগোপান রমেশের পোস্টার পাওয়া যাচ্ছে মেলায়। রেয়ার। কলেক্ট করতে হচ্ছে।
- আমরা নাগরদোলায় চড়ব, কেমন? ওই ঢাউসটায়। একসঙ্গে। পাশাপাশি।
- নাগরদোলায়?
- হ্যাঁ। সবার সামনে তোকে আলাদা করব বলতে পারব না। চুপচাপ পাশে এসে বসবি।
- নাগরদোলাফাগরদোলা আমার পোষায় না।
- তুই ভয় পাস?
- ভয়? কী যে বলিস তুই ঝুমি। ব্যাপারটা অত্যন্ত জুভেনাইল। হাস্যকর।
- তুই এত বড় গাধা কেন রে?

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু