Friday, December 31, 2021

অভি, মানুদা আর নিউ ইয়ার



- অভি, লেট বাই থার্টি ফাইভ মিনিটস।

- সরি মানুদা৷ মাইরি, সরি৷ আসলে নিউইয়ারের মুখে লোকজনের এত হুজুগ৷ ট্র‍্যাফিকে ফেঁসে গিয়েই..।

- বাজে কথা না বাড়িয়ে আগে চা চাপিয়ে দে।

- আহ, তোমার বাড়িতে এলাম৷ কোথায় তুমিই স্টোভ জ্বালিয়ে..।

- গুরুজনের মুখে ওপর বেশি কথা বলতে নেই। 

- আচ্ছা, পাঁচ মিনিট দাও। একটু জিরিয়ে নিই। বাপ রে! বাসে সে যে কী ভিড়! 

- চায়ের সঙ্গে একজোড়া অমলেটও ভেজে আনিস, কেমন? ফ্রিজে আছে ডিম৷ 

- উফ, তোমার সেবা করতে এলাম নাকি?

- রাতের বিরিয়ানিটা আমিই খাওয়াব তো৷ অত তিতিবিরক্ত হচ্ছিস কেন।

- বলছিলাম, আর কেউ আসছে নাকি মানুদা?

- সে কী! আমার বাড়িতে আর আসবেটা কে৷ আত্মীয়স্বজন বলতেও তুই৷ বন্ধুবান্ধব বলতেও তুই৷ তুই কি নিউ ইয়ার্স ইভ পার্টি এক্সপেক্ট করে এসেছিস এ'খানে? তা'হলে পত্রপাঠ তোর ওই গদাই দত্তদের তাসের আড্ডায় চলে যা৷ চাই কী সে'খানে দু'দাগ দামী মদও জুটতে পারে৷ মাগনায়। 

- গদাই দত্তের আড্ডায় আজ সিঙ্গল মল্টের পাশাপাশি শুনেছি বিপুল সেনও থাকবে৷ স্টার অ্যাট্রাকশন! 

- থিয়েটার অভিনেতা বিপুল সেন?

- গতবছর তিনটে সিনেমাও রিলিজ করেছে ওর৷ তিনটেই সুপারহিট৷ 

- গদাই দত্ত আসর জমাতে জানে বটে৷  তা' সে'খানে তো তোর অবাধ যাতায়াত৷ সেই হাইক্লাস ফুর্তি ছেড়ে এই ব্যাচেলরের বিমর্ষ আস্তানায় কী করছিস রে অভি?

- অ্যানুয়াল হ্যাবিট৷ এ'বারেও ভাবলাম যাই৷ তোমায় চা-অমলেট খাইয়ে আর বিরিয়ানি প্রসাদ পেয়ে বছর শেষ করলে আগামী বছর ভালো কাটবে৷ 

- তা অবশ্য ঠিক৷

- চাকরীটা ভাবছি ছেড়ে দেব।

- আমায় দিয়ে রেসিগনেশন লেটার লেখাবি?

- ধুস৷ 

- তবে?

- আমি কিন্তু সিরিয়াস। 

- এ তো ভালো কথা। কদ্দিন আর ন'টা-ছ'টার ছকে আটকে থাকবি৷ তোর ট্যালেন্ট আছে৷ অধ্যাবসায় আছে৷ ভাবনা কী?

- এই এনকারেজমেন্টের জন্যই তোমার কাছে আসা৷ 

- চট করে চা'টা বানিয়ে আন৷ তারপর তোর চাকরী ছাড়ার প্ল্যান সবিস্তারে শোনা যাবে৷ 

**

- সত্যি অভি, তুই চা'টা বড্ড ভালো বানাস৷ দশে সাড়ে দশ।

- অমলেটটা কত স্কোর করেছে?

- দশে সোয়া সাত৷ পেঁয়াজটা যথেষ্ট মিহি করে কুচোসনি৷ সামান্য বেশি ভেজে ফেলেছিস৷ তাই সামান্য নম্বর কাটতে হল। 

- ডিউলি নোটেড।

- কবে ছাড়ছিস? চাকরী?

- ভাবছি সামনের হপ্তাতেই বসকে চিঠি ধরিয়ে দেব।  তারপর মুক্তি।

- মুক্তি! বাহ্!

- তুমিই বলো মানুদা৷ এই অজস্র ফাইল, খামোখা মিটিং, গাম্বাট সব টার্গেট; দিনের পর দিন, মাঝেমধ্যে মনে হয় জম্বি হয়ে পড়েছি৷

- জ্যান্ত লাশ হয়ে পড়ে থাকা মোটেও কাজের কথা নয়। 

- থ্যাঙ্ক ইউ৷ আমি জানতাম তুমি অন্তত বুঝবে।

- তা, রেসিগনেশনের পর?

- প্ল্যানটা এখনই ঠিক কষে রাখিনি৷ তবে লেখালিখি করেই আয়টায় করার চেষ্টা করব'খন৷ কিছুদিনের স্ট্রাগল৷ তবে ম্যানেজ ঠিক হয়ে যাবে। 

- এই তো চাই৷ রিস্ক না নিলে চলবে কেন? চিরকাল দুধেভাতে নেকুপুষু হয়ে পড়ে থাকলে শাইন করবি কী করে?

- মানুদা৷ তোমার কথা শুনে বুকে বল পাচ্ছি৷ সামনের বছরটা অন্তত অন্যরকম একটু..।

- এই দাঁড়া, বিরিয়ানিটা অর্ডার দিই।

**

- উফ্৷ বিরিয়ানিটা এক্কেবারে টপক্লাস ছিল মানুদা। দশে বারো।

- আর চাপটা?

- দশে নয়৷ আর একটু ঝাল দিতেই পারত।  

- কী ভাবলি? রেসিগনেশনটা নিয়ে?

- নামিয়েই দি৷ 

- নিশ্চয়ই নামাবি।

- সুমি একটু চিন্তিত৷ অবশ্য ওর আপত্তি নেই৷ তাছাড়া ওর চাকরীটাই তো আমার ভরসা।

- সুমি কনফিডেন্ট মেয়ে৷ তোকে ঠিক সামলে নেবে।

- মানুদা।

- বল।

- গদাই দত্তের তাসের আড্ডায় কেউ কোনওদিনও বিশ্বাস করবে না যে এই পনেরো বছরের চাকরীটা ঝুপ করে ছেড়ে দেওয়ার দম আমার আছে। যতবার বলেছি, উড়িয়ে দিয়েছে।

- দ্যাখ অভি, গদাই দত্তের আড্ডায় সিঙ্গল মল্ট থাকতে পারে৷ কিন্তু তোর মত ক্রিয়েটিভ মানুষকে চেনার ধক ওদের নেই৷

- ওদের আমি থোড়াই পাত্তা দি৷ তোমার ওপিনিওনটাই জানার দরকার ছিল। 

- তুই যাই করিস, শাইন করবি৷ এ আমি নিশ্চিত।

- আর এক কাপ চা বসাই মানুদা?

- হোক।

***

- বাহ্৷ এই না হলে চা৷ চমৎকার বানিয়েছিস অভি।

- আরে, বারোটা বেজে দুই৷ হ্যাপি নিউ ইয়ার মানুদা।

- হ্যাপি নিউ ইয়ার। 

- জানো,  চাকরীটা ছাড়তে একটু হলেও বুক কাঁপবে।

- স্বাভাবিক।

- আসলে..নিজের ক্রিয়েটিভ প্যাশনকে আদৌ পাত্তা না দেওয়াটা যে অন্যায় হচ্ছে..সেই অনুভূতিটা মাঝেমধ্যেই ট্রাবল দেয়।

- এই যে ছটফট তোর মধ্যে আছে। সে'টাই তোর প্যাশন অভি। 

- গদাই দত্তরা যাই বলুক৷ আমি ভীতু নই মানুদা৷ চাকরী ছাড়ার সাহস আমার আছে৷ 

- আলবাত আছে৷ কিন্তু তোর প্রমাণ করার কিছুই নেই৷ আর একটা কথা বলি অভি? একত্রিশ  ডিসেম্বর রাত্রে তুই এই বুড়োটার সঙ্গে আড্ডা জমাতে এসেছিস, সে'টাও কম দুঃসাহস নয়।

- আমি তো প্রতি বছরই শেষ দিনটা তোমার সঙ্গেই কাটাই মানুদা। 

- রাইট।

- প্রতি বছর চাকরী ছাড়ার প্ল্যানটাও বুক বাজিয়ে বলতে আসি। 

- আসিস।

- অথচ ছাড়া হয় না।

- একদিন ঠিক ছাড়বি। একদিন অন্য কিছু করবিই, দারুণভাবে৷ 

- ঠিক ছাড়ব একদিন না একদিন! শালা গদাই দত্ত আর তার দলবল যতই খোঁটা দিক। ও'দের ঠিক দেখিয়ে দেব।

- আলবাত!

**

- হ্যালো!

- হ্যালো, মানুদা৷ 

- বল সুমি।

- অভি আছে?

- ও তো এই বেরোল৷ ট্যাক্সি নিয়েছে৷ আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবে।

- শুনেছ নিশ্চয়ই৷ প্রতিবারের মত এ'বারেও ওর নিউ ইয়ার রেজোলিউশন; চাকরী ছেড়ে লেখালিখি নিয়ে পড়ে থাকবে। 

- জানি। 

- তোমার কী মনে হয়, এ'বারে সত্যিই ছাড়বে?

- প্রতিবারের মত এ'বারেও অভি গদাই দত্তের আড্ডায় নিজের স্টেটাস আপগ্রেড করতে চেয়ে চাকরী ছাড়তে চাইছে রে সুমি। নিজের প্যাশনের টানটা হয়ত এখনও সে'ভাবে চাগাড় দেয়নি ওর মধ্যে৷ তুই তো জানিস, আমার কাছে সে ফিবছর আসে শুধু সে'টুকু নিজেকে মনে করাতে। আর হ্যাঁ, আমার কাজ ওকে মনে করানো গদাই দত্তদের জাজমেন্টাল জ্ঞান-টীকা-টিপ্পনিই শেষ কথা নয়, ওর মধ্যে সত্যিই সৎসাহস আছে৷ আর আছে হাইক্লাস চা বানানোর ক্ষমতা। তোর বরটা সত্যিই একটা ক্রিয়েটিভ জিনিয়াস।

- হে হে৷ তা বটে৷ পরের বছর আমিও কিন্তু যাব অভির সঙ্গে, তোমার ফ্ল্যাটে৷ বিরিয়ানি আমাকেও খাইও৷ 

-  জো হুকুম। হ্যাপি নিউ ইয়ার সুমি।

- হ্যাপি নিউ ইয়ার মানুদা৷ গুড নাইট৷

No comments: