Skip to main content

প্ল্যাটফর্ম আর টিকিট কাউণ্টার



- সাহেব, কফি চলবে নাকি?
- কফি?
- এখন তো সবে পৌনে বারোটা। যা খবর তা'তে ট্রেন অন্তত দেড় ঘণ্টা লেট। ভোর হয়ে যাবে আসতে। গাঁওদেহাতের শীতের রাত। তাই বলছিলাম..।
- টিকিট কাউন্টারের লোকটা ছাড়া আর কেউ আছে নাকি আশপাশে? চায়ের দোকান দেখলেন নাকি কোনও অজয়বাবু?
- হেহ্। কী যে বলেন সাহেব। স্টেশন আসার পথে তো দেখলেন, মাইল পাঁচেকের মধ্যে কোনও গেরস্থালী নেই।
- তা'হলে কফি..?
- এই যে।
- ওহ্। আপনার ফ্লাস্ক!
- দিল্লী থেকে এদ্দূরে ইন্সপেকশনে এসেছেন সাহেব। সরকার বাহাদুরের রিপ্রেজেনটেটিভ বলে কথা৷ যদিও আমি নেহাতই কপালজোরে আপনার লেজুড় হয়ে জুটে গেলাম। তবু, আপনার সামান্য যত্নটত্ন তো ফেলো-বাঙালি হিসেবে আমায় করতেই হবে, কী বলুন! আসুন, এই যে এক কাপ। ব্ল্যাক। তবে চিনি আলাদা করে চাইলে পাবেন।
- নাহ্। ব্ল্যাক ইজ গুড।
- দেহাতের শীতে কেমন কামড় দেখেছেন?
- মারাত্মক। যাক গে৷ কাল বিকেলের আগে পাটনা পৌঁছনো যাবে বলে তো মনে হচ্ছে না৷
- তাই তো মনে হচ্ছে৷
- বাহ্৷ কফিটা দিব্যি অজয়বাবু৷ থ্যাঙ্কিউ।
- সাহেবের ভালো লেগেছে৷ আমি তাতেই তৃপ্ত।
- আচ্ছা! টিকিট কাউন্টারের লোকটা যেন কেমন, তাই না?
- হ্যাঁ। হাবাগোবা।
- শুধু তাও নয়৷ চাউনিটাও কেমন যেন৷ অবশ্য এই শীতের রাতে প্ল্যাটফর্মে উটকো প্যাসেঞ্জার এসে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাবে, এটা বোধ হয় সে আশা করেনি। কিন্তু কী অদ্ভুত, আমাদের এত হাঁকডাক শুনেক টুশব্দটি করল না! যাক গে, আপনার সিগারেট চলে নাকি?
- নাহ্ সাহেব। বছর সাতেক হল স্মোকিং ছেড়েছি। আপনি খান।
- না থাক। পরেই ধরাবো না হয়।
- আপনার সুটকেসে একটা কম্বল আছে না? পারলে জড়িয়ে এই বেঞ্চির ওপরেই লম্বা হয়ে পড়ুন৷
- এ হাড়কাঁপানো শীতে দু'চোখের পাতা এক করতে পারব বলে মনে হয় না৷ তার ওপর এই কড়া কফি। তবে চেষ্টা করতে পারি।
- বেশ৷ কফিটা শেষ করে আপনি বেঞ্চিতে কম্বল পাতার জোগাড়যন্ত্র করুন। আমি বরং কাউন্টারের লোকটাকে আর একবার জ্বালিয়ে আসি৷ ট্রেনের নতুন কোনও খবর হল কিনা জানা দরকার। অবশ্য, যদি রেস্পন্ড করে৷ অদ্ভুত ক্যারেক্টার একটা।
- এত অল্প সময়ের পরিচয়ে আপনি যে'ভাবে আমায় সাহায্য করছেন অজয়বাবু..আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ৷ মাঝরাস্তায় আচমকা গাড়িটা ব্রেকডাউন হওয়ায় যেন অথৈজলে পড়েছিলাম। ভাগ্যিস আপনার সঙ্গে দেখা হল তাই..।
- এ'সব বলে আবার লজ্জা দেওয়া কেন সাহেব৷ আমি সামান্য কেরানী মানুষ, আপনার জন্য এ'টুকু করতে পারছি, সে'টা তো আমারই গুড ফরচুন। নিন, রাজশয্যা পেতে ফেলুন। আমি ঘুরে আসি।
**
- এই যে! এই য্যো! শুনছেন?
- ক..কউন..।
- এইত্তো৷ তা বলছি পাটনা যাওয়ার ট্রেনের আর কোনও খবর এসেছে? আরও লেট করছে কী?
- কউনসা টিরেন?
- আপনি তো বাংলা জানেন সাহেব৷ খামোখা হিন্দী বলা কেন। কাউন্টারে যতই কম্বলমুড়ি দিয়ে মটকা মেরে পড়ে থাকুন, আমি আপনাকে চিনি।
- আ..আমি..ত..তাই তো। আমি বাংলা জানি।
- আলবাত জানেন৷ অবশ্য, আপনি ভুলেও যান৷ তবে ক্ষতি নেই৷ আমি আছি তো মনে করিতে দেওয়ার জন্য৷
- আ..আপনি..আপনি..আপনি তো..।
- আমি অজয়৷ আপনার বহুবছরের সঙ্গী। একমাত্র বন্ধু৷
- বন্ধু? আমি..আমি আপনার বন্ধু নই৷ আমি বন্দী। আমার...আমার মনে পড়েছে..।
- কী মনে পড়েছে সাহেব?
- ইন্সপেকশন সেরে পাটনা ফিরছিলাম৷ গাড়ি বিগড়ে যায়৷ তারপরই আপনি আচমকা উদয় হন৷ ট্রেনে পাটনা যাওয়া যাবে বলে এই প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসেন৷ তারপর...তারপর..।
- আপনাকে কফি খাওয়াই৷ প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চিতে শুতে বলি৷ আর তারপর আপনি স্রেফ হারিয়ে যান৷ মাঝেমধ্যে আপনার ঘুম ভাঙে। আপনি জেগে ওঠেন এই টিকিটকাউন্টারের একছত্র অধিপতি হিসেবে৷ থ্রিলিং না?
- আমি..আমি..আমি বেরোতে চাই।
- ও মা। আমি তো নিজের ম্যাজিকে বছরের পর বছর সুখে বাস করছি৷ দিব্যি ঝাড়াহাতপা। এই প্ল্যাটফর্ম কারুর চোখেও পড়েনা, কেউ আমাদের জ্বালাতেও আসে না৷ শুধু সেই পাটনার ট্রেনের অপেক্ষা৷ যে অপেক্ষা শেষ হবে এমন আশঙ্কাও নেই। সে ট্রেনও আবার দেড়ঘণ্টা লেটের হিসেবে আটকে, ওই বছর কুড়ি ধরে৷ এমন দুর্দান্ত জায়গা থেকে আপনাকে বেরোতে দিলে চলবে কেন? যাক গে৷ জানেন, মাঝেমধ্যে; কুড়ি বছর আগের আপনার ইন্সপেক্টরসাহেব অবতারটি আপনার বর্তমান টিকিট কাউন্টারে বসা গ্রাম্য চেহারা আর চাউনি দেখে অবাক হয়ে পড়ে? আপনাকে সে বিস্তর ডাকাডাকিও করে, কিন্তু আপনি সাড়া দিতে পারেন না৷ ঠিক যেমন কুড়ি বছর আগেও সাড়া দিতে পারেননি! ম্যাজিক! ও কী, ঝিমিয়ে পড়ছেন যে ফের..ও মশাই..।
- ট্রেন..ট্রে...টিরেন দেড় ঘণ্টা লেট ছে..।
- বেশ৷ আপনি ঘুমোন৷ আমি বছর কুড়ি পুরনো আপনিকে আমার এই জাদু ফ্লাস্কের কফি খাইয়ে আসি'খন।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু