Skip to main content

রমাপদর ক্রাইম



রাত পৌনে একটার সময় বিশুর চায়ের দোকানে লোকজনের আনাগোনা বাড়ে৷ হাইওয়ে ঘেঁষা জীর্ণ দোকানঘরটা গোটা দিন ঝিমিয়েই থাকে, কিন্তু রাত বাড়ালেই চনমনে ভাব৷ মূলত যাদের আড্ডা বসে, তারা সকলেই গোলমেলে৷ চোর, মাস্তান, ছিনতাইবাজ, তোলাবাজ, এমন কী খুনি মানুষজনের আনাগোনাও রয়েছে৷ কিন্তু বিশুর ব্যবসাটা ষোলোআনা সৎ৷ চায়ের কোয়ালিটি টানটান, বিস্কুট টাটকা এবং মুচমুচে, মামলেটের পেঁয়াজ লঙ্কা তরতাজা আর থালা-বাসন-প্লেট সবই ঝকঝকে তকতকে৷ খদ্দেরদের হাঁড়ির খবর নিয়ে সাধারণত মাথা ঘামান না বিশু৷ তাদের জামাই-আদরে চা-বিড়ি-বিস্কুট-মামলেট-ডিমরুটি খাইয়ে, সে'সবের দাম বুঝে নিলেই বিশুর কাজ শেষ৷ আর হ্যাঁ, নিজের চায়ের দোকানের পরিসরে মদ ও মাতলামি ব্যাপারটা বরদাস্ত করেন না তিনি৷ তবে তার চায়ের এমনই টান, যে মাস্তানরা চোলাই বাদ দিয়ে সে চা খেতে তার দোকানে ছুটে আসে৷ তাদের আবদার সামাল দেওয়া কি কম কাজ? সঙ্গত দেওয়ার জন্য দু'টো ছোকরা রয়েছে, তবুও রোজ সন্ধের পর থেকে আর্থ্রাইটিসের ব্যথা ভুলে বিশুকে ছুটে বেড়াতেই হবে৷
শুধু রমাপদ এলে ব্যস্ততা বাদ দিয়ে দু'দণ্ড তার কাছে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসেন তিনি৷ রমাপদর পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল, আলাভোলা চোখের দৃষ্টি, মুখে সর্বক্ষণ হাসি। হাফ শার্ট আর ট্রাউজার দেখে মনে হয় যেন সে বিশুর চায়ের দোকানের রাতের আড্ডায় খানিকটা বেমানান৷ ভদ্রলোক চোর, খুনি না মাস্তান; বিশু তা জানেন না৷ পুলিশের ইনফর্মার হলেও আশ্চর্যের কিছু নয়৷ বিশু শুধু জানেন যে রমাপদর কথা শুনতে তার ভালো লাগে৷ ব্যবসা হিসেব ছুটোছুটি; এ'সব কিছুর মাঝে রমাপদ যেন নদীর গা ছুঁয়ে ভেসে আসা মিঠে বাতাস৷ রমাপদকে বন্ধু হিসেবে ভাবতেই ভালো লাগে বিশুর৷ হপ্তা-পনেরোদিনে একবার আসেন রমাপদ৷ টেবিলে বসে বিশুর নাম ধরে হাঁক পাড়লেই হল৷ নিজের হাতে বাড়তি দুধে চা বানিয়ে নিয়ে আসবেন বিশু৷
তারপর শুরু হবে গল্প৷ আজ চায়ের সঙ্গে আলুর চপ ভেজে এনেছিল বিশু৷ চপে কামড় পড়তেই রমাপদর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল৷ খুশি হল বিশু৷
- বিশু, এমন নিখুঁত চপ ভেজেছ! মুচমুচে, অথচ তেল চুপচুপে নয়৷ ভিতরের আলু যেমন মোলায়েম তেমনই তার স্বাদের স্পার্ক৷ অথচ মশলার বাড়াবাড়ি নেই৷ তুমি যে শিল্পী ভায়া৷
- আহ, তোমার সবেতেই বাড়াবাড়ি রমা।
- আমাদের জীবনে অত হিসেব করে চললে চলবে কেন বলো৷ এই আছি, এই নেই৷ আজ ঝাড়াহাতপা, কাল চালান৷ বাড়াবাড়ি ছাড়া আমাদের চলবে কেন?
- ইয়ে, ভাই রমা৷ তুমিও কি এই বাকি ছেলেপিলেগুলোর মতই..। ইয়ে..মানে..।
- ক্রিমিনাল? হ্যাঁ।
- ও মা। ওইভাবে বলতে চাইনি।
- ক্রিমিনালের আবার এইভাবে ওইভাবে কী?
- মানে..ও'ভাবে জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হয়নি৷
- এমন আলুর চপ খাইয়ে তুমি যদি দু'এক পিস হাড়গোড় খুলে দিতে বলতে, না করতাম না৷ বিশ্বাস করো।
- হে হে৷ কী যে বলো।
- কাজেই ভাই বিশু৷ তোমার মত সৎপথে খেটে খাওয়া মানুষ আমি নই৷ তোমার বেশিরভাগ খদ্দেরের মত, আমিও ক্রিমিনাল৷
- মাস্তানি?
- ছোহ্৷ ও'সব তো ছেলেখেলা।
- ইয়ে, চুরিটুরি?
- ফুহ্৷ ও'সব এলেবেলে ব্যাপার।
- তবে..তবে কি ওই ব্যাঙ্ক ডাকাতি টাকাতি? শোনো রমা, আমি কিছু মনে করব না৷ তুমি আমার বন্ধু।
- তুমিও যে আমার বন্ধু ভাই বিশু৷
- ইয়ে মানে, খুনটুন গোছের কিছু? মানে..কপালের ফেরে পড়ে মানুষকে কবে যে কী করতে হয়..।
- না ভাই৷ খুন তো ফটাফট এস্পারওস্পার৷ তাছাড়া ইতিহাস পড়লে জানবে কত দেশের হর্তাকর্তারা হাজারে হাজারে মানুষ সাফ করে দেবতার আসন আলো করে বসেছেন৷ কাজেই মানুষ খুন ব্যাপারটা মানেই যে ক্রাইম, সে'টা ঠিক নিশ্চিত হয়ে বলা যাচ্ছে না৷
- তবে?
-সবার কাছে স্বীকার করতে সাহস পাইনা৷ তবে এই আলুর চপের প্রতিদান হিসেবে তোমায় আমার ক্রাইমের হদিস জানিয়ে রাখি৷
- আমি কিন্তু তোমার কথা পাঁচকান করব না।
- করলেও আমায় জেলে চালান করতে পারবে ভেবেছ? সে গুড়ে বালি। শোনো ভায়া, আমি রোজ গুম করি৷ কিডন্যাপ করি৷ কাকে? নিজেকে৷ হপ্তায় ছ'দিন, মাঝেমধ্যে সাতদিনই৷ সকাল ন'টা থেকে রাত আটটা৷ মাঝেমধ্যে মাঝরাত হয়ে যায়। যে কাজের প্রতি টান নেই, ভালোবাসা নেই; সে কাজে জানপ্রাণ লড়িয়ে দিই টিকে থাকার জন্য৷ কাদের জন্য এ'ভাবে টিকে থাকা? ভালোবাসার মানুষ৷ পরিবার৷ বন্ধুবান্ধব৷ যাদের ফোন আমি নিয়মিত কেটে দিই৷ যাদের মেসেজের উত্তর দিই না ব্যস্ততার অজুহাতে৷ যাদের কথা ভাবলেই মনখারাপ অথচ যাদের সামনে বসলে কথা ফুরিয়ে যায়৷ কারণ আমি ব্যস্ত মানুষ৷ ক্রিমিনাল নই কি? ভাই?
- আলুর চপ আর এক রাউন্ড ভাজতে বলে আসি ভাই রমা?
- তুমি যে আমার থেরাপিস্ট ভাই। তোমার প্রেসক্রাইব করা ওষুধ ফেরাই কী করে।
- আমি কী? ওই থেরা কী বললে ভাই?
- চপ নিয়ে এসো৷ বুঝিয়ে বলছি৷

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু