Skip to main content

নির্মলবাবুর পাগলামো

এ এক বিশ্রী নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্মল আমার বন্ধু, কোথায় তাঁর পাগলামি বন্ধ করতে উদ্যত হব, তা নয়; তাঁকে রীতিমত প্রশ্রয় দিয়ে চলেছি। গত তিন মাস ধরে রোজই ভাবছি; আজ আর নয়। আর কিছুতেই নির্মলের বাড়ি যাওয়া চলবে না। অথচ তবু প্রতি অমাবস্যার সন্ধেবেলা অফিস থেকে ফেরার সময় একবার ইচ্ছে করবেই- "যাই, দেখি আজ তাঁর প্ল্যানচেট কেমন দাঁড়ায়"। অকাল্ট, তন্ত্র, তুকতাক; এ'সবে একসময় একটু আগ্রহ ছিল বটে, হয়ত সেই টানেই এখনও নির্মলের পাগলামিতে সায় দিয়ে ফেলছি। তবে উপকারের বদলে এতে ওর বেশ ক্ষতিই হচ্ছে।

আর ব্যাপারটা গোটাটাই যে ডাহা বুজরুকি; সে'টাও চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাই। সন্ধে সাড়ে সাতটা বাজলেই ঘরের সমস্ত জানালা বন্ধ করে, বাতি নিভিয়ে; নিজের তর্জনীর ডগাটা রাখবে বাহারি সেন্টার টেবিলটা মধ্যিখানে। আর আমায় বলবে;
"আনন্দ, তোর সমস্ত ফোকাস আর এনার্জি এই বিন্দুতে থাকা চাই, কেমন? আর হ্যাঁ; দীপার মুখটা মনে করার চেষ্টা কর। তুই তো তাকে দেখেছিস বার কয়েক। আমার দীপাকে যারা একবার দেখেছে তারা সহজে ভুলবে না। কোঁকড়া চুল, ডাগর চোখ,  ডান গালে একটা তিল, গায়ে ল্যাভেন্ডারের নরম সুবাস। ফোকাস, কেমন"?

এরপর সে 'দীপা, দীপা' বলে বিড়বিড় শুরু করবে। ঘণ্টাখানেক চলবে সেই বিড়বিড়, শেষে ঘেমেনেয়ে প্রচণ্ড অস্থির হয়ে পড়বে সে। অথচ নির্মলের সদ্যমৃতা প্রেমিকার আত্মার কোনো হদিশই মিলবে না। টেবিল নড়ে ওঠার কথা; সে'টা থাকবে স্থির। মাঝখান থেকে ঘণ্টাখানেক কেটে গেলে আমি বিরক্ত হয়ে টেবিলে চাপড় মারব আর ব্যর্থ রাগের বসে টেবিলে একটা লাথি কষাবে নির্মল। আমি ওকে তখন শান্ত করার চেষ্টা করব। এ'টাই নিয়ম। নির্মল আমার ছোটবেলার বন্ধু, আর কেউ না বুঝুক; আমি অন্তত ওকে এ অবস্থায় একা ফেলে যেতে পারব না।

আজকেও তাই হল।

- দীপা আমার সঙ্গে জাস্ট ছেলেখেলা করছে।
- তোর মাথাটা জাস্ট গ্যাছে নির্মল।
- আমি ঠিকই বলছি আনন্দ। শিমলার মনোহর সিংয়ের বাংলোয় আড়াই মাস আমি এমনি এমনি কাটিয়ে আসিনি। দু'জন মানুষের নিশ্ছিদ্র মনসংযোগ আর সঠিক তিথি ও মুহূর্ত; এই দুই মিলে অসাধ্য সাধন করা যেতে পারে; আত্মা টেনে নামানো তো কোন ছাড়। কিন্তু...কিন্তু জানিস আনন্দ; আমি দীপার আত্মার উপস্থিরি রীতিমত টের পাই।
- তোর ওই প্ল্যানচেটের সময়?
- ইয়েস। স্পষ্ট। ওর শরীরের গন্ধ আমার নাকে আসে।
- তোর দরকার একজন থেরাপিস্ট।
- আনন্দ প্লীজ, তুই আমার বন্ধু। তুই আমায় একটু সাপোর্ট করবি না?
- সাপোর্ট না করলে তোর খামখেয়ালিপনা এন্টারটেন করতে প্রতি অমাবস্যায় এখানে আসতাম না।
- আর কিছুদিন আয় ভাই,আমায় বিশ্বাস দীপা একদিন আমাদের সঙ্গে কথা বলবেই। দীপা আমায় ভালোবাসত রে, মনপ্রাণ দিয়ে। ও আসবে, আসবেই। একার কনসেন্ট্রেশনে প্ল্যানচেট হবে না; প্লীজ ভাই আনন্দ। পরের অমাবস্যায় আসিস।

প্রতিবার রাগের মাথায় নির্মলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি, অথচ পরের অমাবস্যাতেই নির্মলের প্রতি একটা টান অনুভব করি। দীপার অকালমৃত্যুতে বেচারা সত্যিই বড় একা হয়ে পড়েছে। আমি ছাড়া ওর আর কেই বা আছে।

***

- হ্যালো, আনন্দ?
- বলছি। এখন কেমন আছিস তুই নির্মল?
- আগের চেয়ে ভালো। তুই ছ'মাস না এসে ভালোই করেছিস। আমার পাগলামোটা কেটে গেছে ভাই। আমি আর উন্মাদের মত প্ল্যানচেট করে বেড়াই না। দীপার আত্মা নামানোর ভূত এ'বার আমার মাথা থেকে সত্যি গেছে। তুই আসা বন্ধ করার পর আমি শিমলা গেছিলাম, মনোহর সিংয়ের কাছে। আমরা দু'জনে চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। আসলে গোটা ব্যাপারটাই একটা খ্যাপামি ছিল রে, আজ বেশ বুঝতে পারি।
- যাক।
- একদিন দেখা কর প্লীজ। বুঝতে পারছি তুই আমায় এড়িয়ে যাচ্ছিস। কিন্তু আমি খুবই লজ্জিত রে আনন্দ।
- অফিসের কাজে একটু আজকাল ব্যস্ত রয়েছি রে। কিছুদিন পর না হয়...।
- আচ্ছা বেশ, পরেই না হয়।

***

নির্মলকে কী ভাবে বলব যে ওর বাড়ি যাতায়াত আমি এমনি বন্ধ করিনি। আমার আর কোনো উপায় ছিল না। তাছাড়া নির্মলকে বোঝাবই বা কী; এ'টা বলব যে আমাদের প্ল্যানচেট ব্যর্থ হয়নি? ওকে জানাব যে আমার টাক মাথায় দিব্যি কোঁকড়া চুল গজিয়েছে? ডান গালে হঠাৎ করে দেখা দিয়েছে বড় একটা তিল? আর হাজারবার সাবান শ্যাম্পু ঘষে স্নান করেও আমার গা থেকে এই গা কাঁপানো ল্যাভেন্ডারের সুবাস যাচ্ছে না?

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু