Skip to main content

অগ্নীশ্বর



ছোটবেলায় অগ্নীশ্বর সিনেমাটা বড় প্রিয় ছিল। দাপুটে ক্ষুরধার চরিত্রের ডাক্তার। তাঁর প্রতিটি কথার গায়ে যতটা দেমাকের ছাপ, ততটাই তা'তে মিশে রয়েছে অবিচল সত্য যা অনবরত মানুষের মুখের উপর আছড়ে পড়ছে।

কিন্তু ছোটবেলার রুচি চিরকাল স্থির থাকবে না; সে'টাই স্বাভাবিক। ক্রমে আদত লেখাটা পড়লাম, বয়স বাড়ল। সিনেমাটাকে ওভার অ্যাক্টিংয়ের ডিপো মনে হতে লাগল। অনেক সিচুয়েশনকে মনে হতে লাগল বাড়াবাড়ি।

অথচ বয়স দেখছি অতি খতরনাক বস্তু। আর রুচি মহাখালিফা; আজ সে নজরুলগীতি গাইছে তো কাল বলিউডি ঠুমকে তো পরশু ওয়াপিস অতুলপ্রসাদ তো তরশু মুকেশের গলায় ঝুলে কান্নাকাটি।

কী মনে করে আবার অগ্নীশ্বর দেখলাম কে জানে। আবার বুক ছাপানো ভালো লাগা ফিরে এলো। সমস্ত ওভার অ্যাক্টিং স্টোরবাবুর বৌয়ের স্নেহে ধুয়ে গেল। আহা, ফটিকের সন্দেশের প্রতি যে কী লোভ, সেই সৎছেলের লোভ ভুলে তিনি কোন মুখে নিজের পথ্যে দুধ খাবেন? তাঁর প্রণাম নেননি অগ্নিডাক্তার; স্টোরবাবুর বৌ বয়সে ডাক্তারের চেয়ে ছোট, তবু তাঁর মুখের দিকে চেয়ে নিজের মায়ের বিস্মৃত চেহারার মায়াটুকু খুঁজে পান তিনি। প্রণাম নেবেন কী করে?

না স্যার, টিউশনি পড়িয়েও আমায় সিনেমা শেখাতে পারবেন না। স্টোরবাবুর বৌয়ের প্রণাম নিতে না পেরে অগ্নীশ্বর গলার মধ্যে টেনিস বল গুঁজে দেবেন। দেবেনই। আর শেষ বয়সে এসে যখন অবিশ্বাসী রুখাশুখা মেজাজের ডাক্তার দেখলেন যে ফটিক তার মাকে কাঁধে চাপিয়ে তীর্থভ্রমণে বেরিয়েছে; তখন তাঁর মুখের যে আলোময় আস্তিক হাসি ভেসে উঠল- তা দেখলে মনে পূর্ণেন্দু পত্রী মার্কা হাওয়া খেলে যাবে না? তা কি হয়? কাজ নেই আমার সিনেমা বুঝে।

বৃদ্ধ ডাক্তার আফশোস করছেন বাপের ঋণ শোধ করতে প্রতিবেশির জন্য প্রাণপাত করা দেহাতী মানুষটির সঙ্গে আগে দেখা হয়নি বলে, আমরা তা দেখে বলছি 'আহা'। নিজের ছেলে পণ নিয়েছে খবর পেয়ে সে বিয়ের আসর ত্যাগ করে উঠে আসার সময় দাঁত কিড়মিড় করে অগ্নীশ্বর বলছেন "যে দুধে কেরোসিনের গন্ধ তা গিলতে হয় তোমরা গেলো, আমি পারব না", তা শুনে আমরা বলছি "চাবুক'। সুছন্দা যে'দিন মারা গেল সে'দিন ভোরে আবহে 'তুমি নির্মল কর মঙ্গল কর'র ব্যথা ছিল। 'তবু মনে রেখো'য় ডাক্তারের স্ত্রীর আলপনার মত নিষ্পাপ ভালোবাসা ছিল। পুরানো সেই দিনের কথায় হেমন্ত ছিলেন।

আর সিনেমার শেষ প্রান্তে 'ধন ধান্য পুষ্প ভরা'র সুর মিশে গেছিল "দেবী সুরেশ্বরী ভগবতী গঙ্গে, ত্রিভুবন তারিণী তরল তরঙ্গে, জয় সুর তরঙ্গিণী, মকর বাহিনী, পতিত পাবনী, মা গঙ্গে জয় গঙ্গে"র অমোঘ টানে।

সব চেয়ে বড় কথা; দেশের এবং দশের অপদার্থতায় তিতিবিরক্ত ডাক্তার অগ্নীশ্বর মুখুজ্জে শেষ পর্যন্ত এ দেশেই আবার ফিরে আসতে চেয়েছিলেন।

আবারো বলি, কাজ নেই সিনেমার ভাষা খাতায়কলমে বুঝে। বয়সের ওজন যেন কোনোদিন সদ্য 'অগ্নীশ্বর' দেখা মনকেমনের ভার লাঘব না করতে পারে।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু