Skip to main content

শশীবাবু কলি



শশীবাবু; বিহারের গ্যাস প্ল্যান্টের শ্রমিক। ট্রাকে গ্যাস সিলিন্ডার লোড আর আনলোড করতেন। ষাটোর্ধ, ছিপছিপে তামাটে দেহ, ধবধবে সাদা চুল, পাকানো গোঁফ। মুখে সবসময় নারকোল সন্দেশের গুঁড়োর মত হাসি লেপ্টে। সিলিন্ডার ওঠানো নামানোর মাঝে যে'টুকু ফাঁকা সময়, সে'টুকু মিহি গল্পগুজবে কাটাতেন। সমস্ত শ্রমিকদের মধ্যে শশীবাবুর উপস্থিতি যেন একটু বেশি উজ্জ্বল; শান্ত। ধর্মপ্রাণ, ধর্মভীরু নন। লোডিং-আনলোডিংয়ের কাজ টাকার দরকারে করতেন তা নয়; তার দুই ছেলে কর্মরত, ঘরে এবং গ্রামে তাঁকে সকলেই বেশ সমীহ করে চলে; ভালোবাসে। ছেলেরা মাঝেমধ্যে সকাতরে অনুরোধ করে বলে 'বাবা, এ'বারে ঘরে জুত করে বসুন। দিনের বেলা পাড়া ঘুরে বেড়ান, সন্ধ্যে হলে রামায়ণের বই খুলে আসরের মধ্যমণি হয়ে উঠুন'। শশীবাবু হেসে বলেন 'আমি ছেলেদের বলে দিয়েছি, আমার রামায়ণ হল সিলিন্ডার লোডিং আর মহাভারত হল সিলিন্ডার আনলোডিং। এ বয়সে ধর্মত্যাগ করতে পারব না রে'।

সেই শশীবাবুর বলা একটা কথা চিরকাল আমার সঙ্গে রয়ে যাবে।
"কলিযুগের ব্যাপারটা জানেন তো বাবু? আমাদের মধ্যে প্রতি মুহূর্তে ঘেন্না তৈরি হচ্ছে। অনবরত। যে ঘেন্নায় মনে হয় আমি সহজেই আর একজনের টুঁটি ছিঁড়ে ফেলতে পারি। যে ঘেন্নায় মনে হয় অন্যের চামড়ায় পোকা পড়ুক। তেমন ঘেন্না। আর কলির খেল সেখানেই; এই ঘেন্না একটা নেশার মত হয় দাঁড়াবে। জীবনে যথেষ্ট ঘৃণা অনুভূত না হলে আমরা ছটফট করে বেড়াব, হন্যে হয়ে খুঁজব নতুন কারণ; যদি কোনোভাবে পাশে বসা মানুষটার মৃত্যুকামনা করে বুকের জ্বালা জুড়িয়ে নেওয়া যায়"।

শশীবাবুর কলিযুগ থিওরিটা মাঝেমধ্যেই মনে পড়ে। দিব্যি এগিয়ে চলেছি আমরা সেই দিকে।

রাজনৈতিক মতামত এ'দিক ও'দিক হলে মনে অন্য পক্ষের মানুষগুলো জ্বলেপুড়ে গেলে দেশটা শান্ত হবে।
অন্যের প্রিয় লেখকের লেখা আমার বিশ্রী লাগলে মনে হয় সে ভক্তের চোখে গরম শিক ঢুকিয়ে দিলে সামান্য শান্তি জুটবে।
অন্তত তর্কের সময়টুকু মনে হয়ই; "ব্যাটাচ্ছেলের মরণ হয় না কেন?

একদিকে ভাষার তফাতে দমবন্ধ হয়ে আসে।
ধর্মের তফাতে লাশ ছড়িয়ে দেওয়া তো জলভাত।
অন্য দিকে পর্যাপ্ত জল নেই।
যথেষ্ট ভাত নেই।
বুক ভরে দম নেবার মত বাতাস নেই।

ভাবলে হাড়হিম হয়ে আসে যে আমার খোকার প্রতিও কেউ কোনোদিন এমন রক্তচক্ষু শানাতে পারে, সামান্য যে কোনো তফাতের সূত্র ধরে।

আর মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করে এই ভেবে যে নিজের অজান্তেই খোকার মধ্যে এমন কোনো ঘৃণা ইঞ্জেক্ট করে দিচ্ছি না তো যে বিষের প্ররোচনায় খোকা এমন রক্তচক্ষু আয়ত্ত করে নেবে?

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু