বালিশের ওয়াড়ে যদি ফ্রিলই না ঝোলে তবে তা চিবিয়ে বিশেষ সুখ নেই। ধবধবে সাদা ওয়াড়ে সাদা সুতোর মিহি কাজ। নরম অথচ বিছানায় লেপটে যায় না। তেমন একটা বালিশ বুকে চেপে সঞ্জীবে উপুড় হয়ে পড়ার কথা। ঠোঁটে মিচকে আভা, চোখে এক ছিপি আবছায়া।
ঈশ্বর বর্মটি দিতে ভুললেও, স্যান্ডো গেঞ্জি দিয়ে বাঙালি পুরুষকে এ যাত্রা রক্ষা করেছেন। সঞ্জীবে আর সঙ্গীতে কোনও মিউচুয়াল লাঠালাঠি নেই। পাশের বাড়ির রেডিও থেকে ভেসে আসা নির্মিলা মিশ্র তাই গাঁট্টা নন, মালিশ।
এ সমস্ত কিছু নিয়ে আলতো ভাসতে শুরু করেছিলেন ভজহরিবাবু। ফেব্রুয়ারির সকালের হাওয়ায় একটা নখের আঁচর আছে, ভজহরি দিব্যি টের পান। তবু জানালা বন্ধ করতে ইচ্ছে করে না। জানালার ওপাশে ভূদেব দত্ত স্ট্রিট তিরতির করে বয়ে চলেছে। রাস্তার বয়ে যাওয়াটা বেশ অনুভব করেন ভজহরি।
অবশ্য এখানে বলে দেওয়া উচিৎ যে ভজহরি এমন অনেক কিছুই অনুভব করতে পারেন বা টের পান যার ব্যাখ্যা চলে না। ভজহরি এটাও জানেন যে তার বাড়ির সামনের ল্যাম্পপোস্টটা শীত বাড়লে তিন ইঞ্চি ডান দিকে সরে যায়, আবার বৈশাখে ফিরে আসে। অন্য কারুর নজরে না পড়লেও ভজহরিবাবুর পড়ে।
সঞ্জীববাবু মাঝেমধ্যে বাড়িতে আসেন। বলা ভালো ঝুপ করে এসে পড়েন। এই যেমন কিছুক্ষণ আগে সামনের ইজিচেয়ারটায় বসে গাইছিলেন;
"খণ্ডন-ভব-বন্ধন, জগ-বন্দন বন্দি তোমায়।
নিরঞ্জন, নররূপধর, নির্গুণ, গুণম"।
এমন মাঝেমাঝেই উদয় হন উনি। কথা বলার সাহস অবশ্য পায়না। তবে একলা থাকার ভয়টা কেটে যায়। ঝুপ করে এসে টুপ করেই মিলিয়ে যান সঞ্জীব। ধবধবে সাদা চুল, মোটা ফ্রেমের চশমা, শীর্ণকায়। ঠোঁট নিঃস্পৃহ কিন্তু যত হাসি ভদ্রলোকের চোখে জমা হয়ে থাকে। হাসিতে চিকচিক করে ভদ্রলোকের চোখ, সেই চিকচিক ঠিকরে ছড়িয়ে পড়ে গোটা ঘরে, বিছানার চাদরে।
আজও ছিলেন। এই মিনিট কুড়ি মত। গান গাইলেন। গা এলিয়ে কিছুক্ষণ কী যেন বিড়বিড় করলেন। ভজহরিবাবু বড় নিশ্চিন্ত বোধ করছিলেন। বিছানায় থুতনি রেখে ঢুলে পড়ার সময়ই সঞ্জীব টুপ করে মিলিয়ে গেলেন।
ঘুমটা আসব আসব করেও এলো না। বাড়ির সামনের মাইকে সরস্বতী পুজোর অঞ্জলি শুরু হয়েছে। জানালা দিয়ে তিন ইঞ্চি সরে দাঁড়ানো ল্যাম্পপোস্টটার দিকে তাকিয়ে মায়া হল ভজহরির। আহা রে, তিন ইঞ্চি বই তো নয়। সেটুকুও কত লুকিয়ে চুরিয়ে সারতে হয়।
মাইকের তালে অঞ্জলি বিড়বিড় করতে গিয়ে হোঁচট খেলেন ভজহরি। প্রতিবারের মত।
"মা। মা গো। বিদ্যা যেটুকু ছিল সব বায়োডেটায় সেঁধিয়েছে। বুদ্ধিটুকু দলা করে অফিসের লেজারে রাখা। সঞ্জীব দাও মা। সঞ্জীব দাও"।
অঞ্জলি শেষে বালিশের ওয়াড়ের জলখাবারে মন দেন ভজহরি।
Comments