Skip to main content

আমার সেলুন

পুরুষ জীবন কম জটিল নয়। 
হুড়ুম করে যা-নয়-তাই ভেবে, দুড়ুম করে যা-নয়-তাই করে ফেলে আমাদের জীবন গুজরান হয়ে যায়, এমন সেক্সিস্ট আইডিয়া থেকে এবার বেরিয়ে আসার সময় এসেছে। কমপ্লেক্সিটির সঙ্গে আমাদেরও অনবরত কুস্তি চলে। 

পুরুষ জীবনের জটিলতম সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে চুল কাটার সেলুন বেছে নেওয়া। এই একটা ডিসিশনে পালটে দিতে পারে সমাজবোধ, জীবনদর্শন। সেলুন চিন্তায় ওম দেয়, ভাবনায় রঙ দেয়, অবসরে কেত দেয়। দেয়। এই পাওয়াগুলো চিনে নিতে পারা দরকারি। জরুরী। 

কথায় আছে সৎসঙ্গে আর মনের মত  সেলুনে স্বর্গবাস, 
অসৎ সঙ্গ আর বিদঘুটে সেলুনে সর্বনাশ।  

সেলুন বেছে নেওয়ায় কোনও থিওরি নেই, অঙ্ক নেই, লিনিয়ার ইকুয়েশন নেই। পুরোপুরি ইন্সটিঙ্কটের খেলা। নচিকেতা ভালোবাসাকে পিটুইটারির খেলা বলে ঠেলে দিয়েছিলেন, কিন্তু পিটুইটারি দেড় মাস রাত জেগে পড়াশোনা করেও সেলুন বেছে নিতে পারবে না। পুরুষ মাত্রই সেলুন-কবি। 

জীবনে বহুবার এই কঠিন সিদ্ধান্তের সম্মুখীন হতে হয়েছে। যখনই বাবার চাকরী, নিজের পড়াশোনা বা নিজের চাকরীর টানে নতুন জায়গায় গিয়ে থিতিয়ে বসতে হয়েছে, সবার আগে খুঁজে নিতে হয়েছে নিজের পছন্দের হেয়ার কাটিং সেলুন। একজন কী'ভাবে নিজের পছন্দের সেলুন বেছে নেয়, সে'টা নিয়ে সামগ্রিক ভাবে থিওরাইজ করা সম্ভব নয়। তবে নিজের ভালোলাগাগুলোর একটা লিস্ট করা যেতেই পারে। 

১। সেলুনের রেট চার্ট আর মানিব্যাগের ওজনের সঙ্গে যে একদম কনেকশন নেই তা নয়। তবে সেই যোগাযোগ অত্যন্ত ক্ষীণ। যারা এই সরল হিসেবে সেলুন বেছে নিয়েছেন বাকি সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর বাদ দিয়ে, তাঁদের জীবনে গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছে। নিশ্চিতভাবেই। 

২। সেলুনে বরাবর কাঁচির আগে গান খুঁজেছি। রেডিও নির্ভরতা নয়। একটা ছোট স্পীকার। তা'তে পছন্দের মত গান। একের পর এক। যে কোন পছন্দের গান নয়। হেমন্তবাবুর গানে সেলুন বিবর্ণ মনে হয়। মান্নাদের বাংলা গান বাজানো সেলুন ঠিক অরে জুলপি সেট করতে পারে না। বড্ড বেশি নতুন হিন্দী গানে সেলুনের আবহ বেলুনে খোঁচা পড়ে। সেলুন সেলুনিত হয় নব্বইয়া,নাদিমশ্রবণযতিনললিতাইজ্‌ড কুমার শানু-উদিত নারায়ণ-অলকা যাগ্নিকে। 
ইস তরহ আশিকি কা অসর ছোড় যায়ুঙ্গা, 
ইস তরহ আশিকি কা অসর ছোড় যায়ুঙ্গা
তেরে চেহরে পে অপনি নজর ছোড় যায়ুঙ্গা।
এ ধরণের গানে কাঁচির মিহি কুচকুচ এক ধরণের অনির্বচনীয় সিম্ফনি তৈরি করে। 
চুল কাটা অত্যন্ত কোদালে ব্যাপার, হাফ ইঞ্চি এদিক ওদিকে মহাভারতের পাতায় আলপিনের খোঁচাও লাগে না। কিন্তু সঠিক সুরে কাঁচি না চললে সে বুকের মধ্যে রক্তক্ষরণ হয়। হয় ভাই, হয়। 

৩। গল্প। প্রত্যেক সেলুনে চুলকাটনেওলা আর নিয়মিত চুলকাটানেওলার গল্পের একটা স্রোত রয়েছে। সেই স্রোতে আমি কতটা গা ভাসাতে পারব, তার সঙ্গে সেলুন চয়নের গভীর সম্পর্ক। 'আসুন বসুন ছোট করে কাটব, না বড়, না মিডিয়াম'; এ'টুকুতে সেলুনের আভ্যন্তরীণ কথাবার্তা ফুরিয়ে গেলে সে সেলুনে চুল খরচ করার কোনও মানে হয় না। পাড়া পলিটিক্সের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য খবরের উৎস হবে সেলুন। আড়াই কিলোমিটার রেডিয়াসের মধ্যে সমস্ত বিয়েবাড়ির মেনু থেকে এস এস সির রেজাল্ট, সমস্ত সার্কুলেট হবে সেলুনের দু'টো চেয়ার আর দেড়টা বেঞ্চকে ঘিরে। 

৪। সেলুনে টিভি বড় ক্ষতিকারক। চুলকাটিয়ের চোখ যায়। লাইন লেন্থ বিগড়ানো বোলার আর নজর হঠে যাওয়া চুলকাটিয়ে অত্যন্ত খতরনাক। তাছাড়া টিভির গোলমালে চুলকাটানেওলা আচমকা ঘাড় ঘুরিয়ে ফেলে জরুরী অ্যাঙ্গেল নষ্ট করে। সেলুনের ডাব সরবতে চোনা হল টিভি। 

৫। ফাউ ফুচকার মোহের চেয়ে হাজারগুণ ওজনদার মোহ হচ্ছে চুল কাটার পরের চুল ঝাড়া ফাউ মাসাজ। দু'হাতের আটটা আঙুলের ডগা আর অল্প তালু মিশিয়ে তিরিশ সেকেন্ডের যে স্নেহপ্রবাহ, যে গালিবি ভালোবাসা; সে'টুকু জরুরী। যে'খানে এই ফাউ নেই, সে সেলুন আমার নয়। 

৬। পুরনো আনন্দলোকের স্তূপ। গার্জেনরা যে বয়সে নবকল্লোলের দিকে তাকালে তিরস্কার করতেন, সে বয়সেই পাড়ার সেলুন আমায় আনন্দলোক চিনিয়েছিল। সে সময় রোববার ছাড়া সেলুনে যেতাম না। কারণ রোববারের ভিড়। লাইন দিয়ে বসে থাকা ঘণ্টা খানেক আর গপাগপ আনন্দলোক গিলে যাওয়া। আহা। সে'সব দিন। ইন্টারনেট বাজি উলটে দিলেও, স্মৃতির আঁচল পাকিয়ে আজও কান খুঁচিয়ে চলেছি। যে সেলুন আনন্দলোকের পুরনো সংখ্যা জমিয়ে রাখবে, তারা বোনাস নম্বর পাবে। 

৭। চুলকাটনেওলার তাড়াহুড়ো থাকবে না কোনও। শিল্পীর হুড়মুড় থাকলে চলে না। পিকাসো ট্রেডমিলে দাঁড়িয়ে ছবি আঁকতেন না। বাৎস্যায়ন ঘড়ি ধরে চুমু খেতে বলেননি। চুল কাটা হবে ধীরে সুস্থে। কাঁচির কুচ্‌কুচ্‌ শব্দে চোখের পাতা ভারী হয়ে আসবে, মনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে শিউলি। ভালোবাসা তৈরি হবে। চুলকাটানেওলার মনে অবিশ্বাস থাকবে না কোনও, আধোঘুমে কেটে যাবে মিনিট কুড়ি। তারপর ঝিমুনি কেটে গেলে আয়নার দিকে তাকিয়ে মিচকি হেসে চেয়ার ছাড়া। চুলকাটনেওলা ব্যাটসম্যান, চুলকাটানেওলা ননস্ট্রাইকার। মিডঅফে বলে ঠেলে চুলকাটনেওলা ছুটবেন। ব্যাটসম্যান্‌স কল। ননস্ট্রাইকার হিসেবে আমার কাজটুকু হল গা ভাসিয়ে দেওয়ার। 

৮। চুলকাটনেওলার স্মৃতিশক্তি ব্যাপারটা ক্রিটিকাল। প্রত্যেকবার গিয়ে চুলের স্পেসিফিকেশন লিস্ট করে বলা বেশ খাটনির কাজ। চোখে চোখে কথা হবে। গোটা বছর এক ছাঁট, পুজোর মরসুম বা বিয়েবাড়ির সিজনের আগে অন্য। সে জানবে। সে বুঝবে। ডাক্তারকে রুগীর নাড়ীনক্ষত্র জানতে হয়। চুলকাটনেওলাকেও জানতে হয়। চিনতে হয়। পাল্‌স বুঝতে হয়। 

নতুন পাড়ায় এসেছি প্রায় এক বছর হতে চললো। মনের মত সেলুন খুঁজে পেতে লেগে গেল এতগুলো দিন। স্রেফ গৃহপ্রবেশের অনুষ্ঠান বা পাড়ার ক্লাবের মেম্বারশিপ দিয়ে পুরুষ হৃদয়কে নতুন পাড়ায় স্থাপন করা যায় না। সেলুনের আশ্বাস ছাড়া পুরুষহৃদয় আশ্রয় খুঁজে পায় না, পেতে পারে না। 

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

ব্লগ-বাজ

আর চিন্তা নেই । বাঙালিকে আর রোখা যাবে না । আর সামান্য (সম্ভবত কিঞ্চিত গোলমেলে ) কবিতা ছাপাবার জন্যে সম্পাদক কে তোল্লাই দিতে হবে না । আর প্রেমে লটরপটর হয়ে ডায়েরি লিখে প্রাণপাত করতে হবে না। পলিটিক্স কে পাবলিক-জন্ডিস বলে গাল দেওয়ার জন্য আর “প্রিয় সম্পাদক” বলে আনন্দবাজারের ঠ্যাং ধরতে হবে না। কেন ?  হোয়াই? বাঙালি ব্লগিং শিখে গ্যাছে যে। ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে শাণিত তলোয়ারের মত “ পোস্ট”-সমূহ জনতার ইন্টেলেক্ট এসপার-ওসপার করে দেবে ; হাতে-গরম গায়ে-কাঁটা। বাঙালি মননের নব্য জিস্পট ; ব্লগ-স্পট । কে বলে যে বাঙালি ব্রিগেডে বুক্তুনি দিয়ে আর ফুটবল মাঠে খেউড় করে খতম হয়ে গ্যাছে ? কে বলে যে বাঙালির ঘিলু কফি হাউসে ভাত ঘুমে মগ্ন ? বাঙালিকে একবার ব্লগখোর হতে দিন , সমস্ত অভিযোগ ভ্যানিশ হয়ে যাবে । পোপ থেকে পরশুরাম ; ডেঙ্গু থেকে মশাগ্রাম ; বং-ব্লগের দাপট রইবে সর্বত্র । বাঙালির সমস্ত আশা-ভরসা-জিজ্ঞাসা এইবারে ব্লগ মারফত্‍ পৌছে যাবে ট্যাংরা ট্যু টেক্সাস । তোপসে মাছের স্প্যানিশ ঝোলের রেসিপি কী ? বাঙাল-ঘটি মিল মহব্বত-হয়ে গেলে কি বাঙ্গালিয়ানা চটকে যাবে ? নেতাজী কি এখ

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু