Skip to main content

দিবাকর আর সেই মেয়েটা

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ সজাগ হয়ে উঠছিল দিবাকর।  আশপাশের খুচরো শব্দগুলো কানে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। এমনিতে গলিটা নিরিবিলি।  মাঝেমধ্যে শুধু রিক্সার ক্যাঁচোরকোঁচর, সাইকেল বেলের ক্রিং কিরং, পথচলতি চপ্পলের চটরফটর বা জুতোর মিয়ানো মচমচ।

হাওড়ার দিকের বিড়িতে স্বাদ আছে, দিবাকর চার প্যাকেট কিনেছিল। সেই একটা ধরিয়ে ল্যাম্পপোস্ট ঘেঁষে দাঁড়ালো সে। সময় হয় এসেছে।

মনের আঁকুপাঁকু ভাবটা ক্রমশ বেড়ে চলেছিল। ভরদুপুরে সেলুন বন্ধ করে চলে আসাটা পাগলামি হয়ে গেল বোধ হয়। ব্যাপারটা এমনই বিদঘুটে যে অন্য কাউকে বলার সাহস পর্যন্ত হয়নি। অবিশ্যি এমনটা না ঘটাই স্বাভাবিক। স্বপ্নাদেশ-ফেশ লোকে পায় শুনেছে, কিন্তু স্বপ্নে পাওয়া প্রেমিকা মাটি ফুঁড়ে উঠে আসবে, এমন গড়বড়ে ব্যাপার হয়নি আগে। আজও হবে না বলেই দিবাকরের বিশ্বাস। তবু, না এসে থাকা গেল না।

অবশ্য, প্রেমিকা ঠিক না। পরিচিতা।  প্রেম প্রেম ভাবটা একান্তই দিবাকরের নিজের মনের মধ্যে। আর হবে নাই বা কেন। ও চোখ জোড়ায় দিব্যি কুয়োর বালতি নামানো যায়। ওই হাসিতে চমনবাহার খাওয়ার পর এক চুমুক জলের হুসহাস ঠাণ্ডা। গত বছর দশেক ধরে নিয়মিত স্বপ্নে দেখা হচ্ছে। নানান গল্প হচ্ছে।

ঝপাৎ করে দেখে যোগিনী টোগিনী মনে হয়। গেরুয়া পোশাক। তবে স্কিনের যা গ্লো, শেহনাজের গোল্ড ফেসিয়াল হপ্তায় একবার না করলে ও চমক আসবে না।

এই মনকেমন ব্যাপারটা অবিশ্যি ওয়ান সাইডেড। মেয়েটি এমনভাবে 'ভাইটি' বলে ডাকে যে বুকের মধ্যে বোলতা কামড়ে ওঠে যেন। যাক গে, এটুকুই বা মন্দ কী। প্রতি রাতে সে স্বপ্নে আসে। কথা হয়।

মেয়েটা বলে দিবাকরও রোজ তার স্বপ্নে আসে।
দিবাকরের মনে হয় দু'জনে দু'জনের স্বপ্নে আসে। এত দিন হয়ে গেল তবু মেয়েটার নাম জানা হলো না। অথচ কত কথা হয় রোজ রাত্রে।

মেয়েটা বড় ভালো। বড্ড ভালো। মেয়েটার মধ্যে কত কষ্ট, কত মায়া। যেটুকু আভাস পেয়েছে দিবাকর, মেয়েটা সম্ভবত ডিভোর্সি। দু'টো ছেলেও আছে। একা দু'টো ছেলেকে মানুষ করা চাট্টিখানি কথা নয়। দিবাকরের একার গেরস্থালী চালাতেই নাভিশ্বাস উঠে যায় আর সে বেচারির মাথায় না জানি কতশত চিন্তা।

আর কত ভালো ভালো গল্প। ঘাসফুল, শ্যাওলার দাগ, ভোরের পুকুরপাড়,  আলপথ, আলপনা, আমের গন্ধ...।

এমনই গল্পে দিব্যি কেটে যাচ্ছিল।
রাতের পর রাত।
স্বপ্নের পর স্বপ্ন।
আলোয় আলো।
বাতাসে তুলোর রোঁয়ার মত নরম ভালোলাগা।

গতকাল রাতের স্বপ্নে মেয়েটা আচমকাই বললে যে সে আসছে। সে নাকি স্বপ্ন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে দিবাকরের জগতে। বিকেলবেলা। দিবাকর যেন একটা নিরিবিলি জায়গা খুঁজে বিকেলটা অপেক্ষা করে, সে পৌঁছে যাবে। কী ভাবে সে আসবে সে'টা জানার আগেই অবিশ্যি স্বপ্ন ভেঙে যায় রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা ছুঁচোর উপদ্রবে বাসন গড়িয়ে পড়ার শব্দে।

স্বপ্নের কথাকে বড্ড বেশি বিশ্বাস করা ফেলা হয়ে গেছে কি? এই ভাবনা নিয়ে খানিক জাবর কাটার সময়ই ঘটল ব্যাপারটা, এই বিকেল পৌনে পাঁচটা নাগাদ। গলিটা তখন বেশ খালি।

মেয়েটা দুম করে এসে পড়লো। দুম করে। সত্যি দুম করে। সত্যি বলতে কী, মাটি ফুঁড়ে। দিবাকরের ইচ্ছে করছিল চোখ রগড়ে নিতে।
অবিকল সে মেয়েটা। সেই চোখজোড়া। তা'তে জল। সে হাসিতে আরও কান্না।

আজ ওর পরনে কেমন যাত্রা মার্কা জবড়জং শাড়ি। গা ভরা গয়না, যাত্রাপালার মতই। যাক গে। এগিয়ে গেল দিবাকর। সে চিনতে পেরেছে, স্পষ্ট। ওর চাউনি বলে দিচ্ছে সেও চিনেছে দিবাকরকে।

কাছে যেতে ভেঙে পড়ল মেয়েটা।

"আর অপমান সহ্য হল না। আর না। চলে এলাম। ও জগৎ ছেড়ে চলে এলাম। সে'খানে আমায় বাঁচতে দিল না গো ওরা। ছিঁড়েখুঁড়ে খেলো আমায়। ছেলে দু'টো মানুষ হয়েছে, আমার আর সে'খানে থেকে কাজ নেই। চলে এলাম। আমায় কাদা না মেখে বাঁচার একটা ব্যবস্থা করে দিতে পার ভাই"?

কারা অপমান করেছে, কারা ছিঁড়েখুঁড়ে খেতে চেয়েছে সে'সব জিজ্ঞেস করতে মন চাইল না দিবাকরের। আহা রে, মেয়েটার কী কষ্ট। একটা রিক্সা ডেকে এবার বাড়ি ফেরা। বাড়িতে মেয়েটাকে পৌঁছে দিয়ে একবার বাজারে আসতে হবে, একটা ছোট দেখে রুই যদি পাওয়া যায়।

রিক্সায় উঠেও মেয়েটার নাম জিজ্ঞেস করতে সাহস হল না। এক জায়গা ফেলে এসেছে, আর ফিরে যেতে চায় না। নামটাও না হয় নতুন দেওয়া যাবে। সবিতা? বিপাশা? দেওয়া যাবে কিছু একটা।

কিছু কথা বলতেই হয়, তাই ঝপ করে ওর দুই ছেলের নাম জিজ্ঞেস করে ফেলেছিল দিবাকর।

শহুরে জঞ্জাট উপচানো এক চোখ কান্না আর মায়া নিয়ে উত্তর দিয়েছিল মেয়েটা;

"লব আর কুশ"।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু