Skip to main content

মিছরি আর সৈনিক

- তুমি এসেছো মিছরি?
- উপায় রাখলে কই? বেহায়া। বেওকুফ।
- বসো। বসো।
- কয়েদী মানুষের অত কথা বলতে নেই।
- কিছু খাবে?
- কয়েদখানায় তোমার মাথাটুকু ছাড়া খাওয়ার আর কী আছে বলবে?
- কোণে একটা কুঁজো রাখা আছে। ওই দ্যাখো, ওই দিকে। ইঁদারার জলের মত ঠাণ্ডা।
- আগে তোমার মাথাটুকু চিবিয়ে নিই, তারপর জল দিয়ে ঢকঢক করে গিলে ফেলবো, কেমন?
- হেহ্। কেমন আছো গো মিছরি?
- সুখেই ছিলাম। সংসার। আত্মীয় পরিজন।  তারপর ওই ভূতে কিলোলো। শুনলাম তোমায় কাল ফাঁসি দেবে। যতই শত্রুপক্ষের সৈনিক হও, এককালে প্রেমিক ছিলে। লোকে দুর্নাম রটালে রটাক,ঝপাৎ করে চলে এলাম। তুমি কেমন আছ?
- দিব্যি।
- শহিদ শহিদ গন্ধ পাচ্ছ নিজের গা থেকে?
- ধুস। আমি ভালো অমলেট বানাতে পারি। শাড়ির কুঁচি ধরতে পারি। চট করে বানিয়ে গল্প বলতে পারি। বাথরুমে ক্লাসিকাল গাইতে পারি। লুডোতে দুর্দান্ত চুরি করতে পারি। শহিদ টহিদ হওয়া আমার কম্ম নয়। নেহাত জোর করে সেনাবাহিনীতে নাম লিখিয়ে নিলে। নেহাত জোর করে যুদ্ধে পাঠালে। মন্দ কপাল, তাই ধরাও পড়ে গেলাম।
- ভাগ্যিস দেশ ছেড়ে তোমার হাতে নিজেকে সঁপে দিইনি গো, নইলে কাল আমায় বিধবা হতে হত।
- মিছরি...তুমি আসবে আমি ভাবিনি...।
- বিয়ে না হওয়া ঠিকই ছিল, কিন্তু তুমি থাকবে না..সে'টা ভাবতে পারছি না যে।
- ও সয়ে যাবে।
- আমাদের বিয়ে না হওয়াটা যেমন তোমার সয়ে গেছিল।
- দু'টো দেশে যুদ্ধ লেগে গেল, আর বিয়ে। মিছরি...বড় আশা করেছিলাম, খবর পেয়ে তুমি একবার আসবে।
- এলাম তো..এবার বলো।
- আমার বলার তো কিছু নেই। সৈনিক মানুষ। খুনোখুনিতে আছি। বলাবলিতে নেই। তুমি কিছু বলবে?
- তুমি আমার দেশের মানুষ মেরেছ?
- হুঁ।
- অনেক?
- অগুনতি। কতগুলো মেডেল পেয়েছি জানো?
- আমার ভাইটা মারা গেছে মাস খানেক আগে। ফ্রন্টে।
- তোমার ভাই? প্রদ্যুম্ন? সে তো কবি মানুষ। যুদ্ধে গেল কেন?
- শাড়ির কুঁচি ধরা যার কাজ, সে বর্ডারে গেছিল কেন?
- ওহ্। সে কদ্দিন আগে দেখেছি তাকে। তখন প্রদ্যুম্ন স্কুলে। এখন হয়তো তাকে দেখলেও চিনতে পারতাম না। কে জানে, ওর বুকে আমিই গুলি চালিয়েছি কিনা।
- কে জানে। হতেও পারে। যুদ্ধ তো দেশের সঙ্গে দেশের। সে'খানে কেউ মিছরির ভাই নয়, কেউ প্রেমিক নয়।
- সবাই সৈনিক, আর কেউ কেউ লাশ।
- তুমি আজ সৈনিক,  কাল লাশ।
- লাশ চুমু খেতে পারে না। সৈনিক বরং...।
- শত্তুরের মুখে বড় বড় কথা! দেব জল্লাদ লেলিয়ে?
- তোমাদের দেশের কোনও গান শোনাবে মিছরি?
- কাল আমাদের দেশের হাতে কোতল হবে, আজ তার গানের খোঁজ করছ?
- তোমার দেশ। তোমার খাটের কোণায় রাখা ডায়েরি, ঢাকনা খোলা কলম, চশমা। তোমার জানালার পর্দা এলোমেলো করা হাওয়া। তোমার মায়ের হারমোনিয়াম। তোমার বালিশের ওয়াড়ে চোখের জল। তোমার রান্নাঘরের স্যাঁতসেঁতে দেওয়াল। তোমার বারান্দায় বিরক্তিকর পায়চারী।  তোমার তুমিটুকু দলা পাকিয়ে রয়েছে মিছরি এ দেশে। আমায় হাজার বার ফায়ারিং স্কোয়্যাডের সামনে দাঁড়ালেও মন কেমন ঘুচবে না। ঘেন্না করতে বড় সাহস দরকার মিছরি।
- ভাইটার গায়ে অন্তত কুড়িটা বুলেট ছিল জানো। একজনকে মারতে ক'টা গুলি লাগে বলো তো?
- মিছরি। কেন এলে?
- ভালোবাসি। অবিকল সেই পুরনো দুপুরগুলোর মত। তখনও খুনোখুনি জানতো না কেউ। তবে, ভালোবাসা আর কীই বা পারে। কতটুকুই বা পারে। আমি ভালোবাসার দায়ে আসিনি গো।
- তবে?
- ক্ষমা করবে গো? তোমার বুকে ওরা গুলি চালানোর আগে মন থেকে ঘেন্না মুছে ফেলে ক্ষমা করতে পারবে এ দেশকে? যে দেশ তোমায় খুন করবে?
- মিছরি...।
- কথা দাও ক্ষমা করবে। তুমি ক্ষমা করলে তার পাপ একটু লাঘব হবে।
- কে মিছরি?
- ঠিক সাতমাস পর তার আসার কথা। তোমার মিছরির সন্তান। তার দেশকে ক্ষমা করে যাবে গো?
- তাঁকেও শাড়ির কুঁচি ধরতে শিখিও মিছরি।
- লুডোয় চুরিটাও দিব্যি শিখিয়ে দিতে পারব।
- হেহ্। কাল ভোর নটায় ঘটবে। তখন গান গেও, কেমন? তোমার দেশের ভালোবাসার গান। আমি গান গাইতে পারি না, আমি চিৎকার করে অমলেটের সিক্রেট একটা রেসিপি বলে যাবো'খন। বন্দুকবাজরা মন দিয়ে না শুনলে জব্বর ঠকবে।

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু