Skip to main content

বিউলির বিশ্বাস

বিউলির চোখে ঘুম নেই। আজ তিন দিন ধরে দু'চোখের পাতা এক হয়নি। বালিশে মাথা ঠেকালে মাথার ভিতর চিড়বিড় করে উঠছে। অথচ শরীর মন অবশ করা ক্লান্তি তাকে গিলে খাচ্ছে যেন। শাশুড়ি মা অবশ্য মাঝেমধ্যেই গায়ে মাথায় হায় বুলিয়ে তাকে শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছেন। কিন্তু সে বেচারির নিজের দুঃখই বা কম কীসে? যে মায়ের জোয়ান ছেলে মাত্র তিন দিনের জ্বরে মরতে বসেছে, তাঁর বুকের ভিতরে কি রক্তগঙ্গা বয়ে চলছে না? বুড়ি বিউলিকে চোখে হারায়।

ক'মাসের মাত্র বিয়ে, তবু এরই মধ্যে নিজের স্বামীকে বেশ মায়া মায়া সুরে ভালোবেসেছে ফেলেছে বিউলি। জানালা বেয়ে চুইয়ে নামা জ্যোৎস্নায় হারুর চিবুক ভেসে যেতে দেখে বিউলি। মায়া হয়। বড় মায়া। বুক ধড়ফড়ানো মায়া।

এই মানুষটাকে এখন দিব্যি ছোঁয়া যায়। চাইলেই চুলে বিলি কেটে দেওয়া যায়। 'বুকে কষ্ট হচ্চে গো" বলে বুকে মাথা রাখা যায়। সে থাকবে না? বর না থাকলে বুক মুচড়ে মুচড়ে ওঠে; বাপের বাড়ির পাড়ার শিউলিপিসি অন্তত তাই বলতেন। হারু থাকবে না? সন্ধেবেলা মেলা থেকে ফেরার পথে অসভ্য সুরে 'অ্যাই বৌ, ইদিকে ঘেঁষে আয়' বলে চিমটি কাটবে না আর সে? বিউলির গলায় রামপ্রসাদী শুনে হারুর চোখ ছলছল হয়ে আসে, তখন বিউলির মনে হয় শীতের রাতে কেউ যেন তার গায়ে ভালোবাসাবাসির লেপ চাপিয়ে দিয়েছে।

এমন স্বামীটা আর থাকবে না? কবিরাজ মশাই অমন থাপ্পড়ের মত কথাগুলো বলতে পারলেন?

কবিরাজমশাই অবশ্য বলেছেন শহরে থেকে বড় ডাক্তার ডেকে নিয়ে আসতে পারলে কিছু একটা হলেও হতে পারে। কিন্তু সে ডাক্তারের খরচ কম নয়। বিউলিদের টাকা নেই।

একটু ভুল হল। বিউলির কাছে একটা গিনি আছে, জমিদার বাড়ির সই এলোকেশীর তাকে বিয়ের সময় দিয়েছিল। আর বিউলি গিনিটা লুকিয়ে রেখেছিল নিজের পুঁটুলির গোপন কোণে। হারুও জানতে পারেনি সে গিনির কথা।  সে গিনি ভাঙিয়ে কবিরাজমশাইয়ের কথামত শহুরে ডাক্তারের ব্যবস্থা করাই যায়। কিন্তু গতকাল থেকে বিউলির মনের ভিতর হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করেই চলেছে। বাপের বাড়ির গাঁয়ের বুড়োশিবঠাকুরের কথা মনে করে সে যখনই কোনও পয়সা মানত করে জলে ভাসিয়েছে, তখনই তার মনোবাসনা পূর্ণ হয়েছে। বিউলির দাদা নিমকি সে'বার দিন দুয়েকের জন্য জঙ্গলে হারিয়ে গেছিল, মায়ের লক্ষ্মীর ঝাঁপি থেকে এক পয়সা চুরি করে দাদার নামে মানত দিয়ে সে পয়সা নদীতে ছুঁড়ে ফেলেছিল বিউলি; পরের দিনই ফেরত এসেছিল দাদা।  কিছুতেই মেজদির বিয়ে ঠিক হচ্ছিল না, বাবার পুরনো দেরাজ থেকে একটা গোটা টাকা চুরি করে নদীতে ভাসাতেই কাটোয়ার পাত্রপক্ষ মত দিয়েছিল। এমনও আরো বেশ কয়েকবার এইভাবে টাকাপয়সা বুড়োশিবের নাম মানত করায় কাজ হয়েছিল। এই মানতগুলোর কথা অবশ্য কাউকে সে কখনও বলেনি।

কাজেই গোটা একটা গিনি জলে ভাসালে কি বুড়োশিব তার স্বামীকে বাঁচিয়ে দেবে না?  অচেনা ডাক্তারের জন্য অন্ধের মত খরচ না করে বুড়োশিবের ভরসা করাই কি উচিৎ হবে না? এক বুক আকুতি নিয়ে ঘাটের দিকে ছুটল বিউলি।

***

"আপনি আমার থেরাপিস্ট যখন আপনাকে খুলে বলতেই পারি। মাঝেমাঝে মেয়েটাকে স্বপ্নে দেখি। সে বড় অদ্ভুত স্বপ্ন। এক নদী কালচে নীল জলে মেয়েটা ডুবে যাচ্ছে। বড় মায়া মেয়েটার চোখে।
মেয়েটার ঠোঁটে অল্প কাঁপুনি।
মুখ ফ্যাকাসে কিন্তু তাতে ভালোবাসা জমাট বেঁধে আছে। মেয়েটা আমার নাম ধরে হাতছানি দিয়ে ডাকে
'আমায় ডুবতে দিওনি শঙ্করবাবু, তোমায় পয়সা দেব'।

এক বুক জলে নেমে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরি আমি। স্বপ্নেই।
আহ, বড় মায়া।

গতকালও স্বপ্নে সে'ভাবেই এসেছিল সে;
'আমায় ডুবতে দিওনি শঙ্করবাবু, তোমায় একটা গিনি দেব'। কিন্তু আমি জলে নামার আগেই অ্যালার্ম ঘড়িটা বিশ্রী ভাবে বেজে উঠল। ভোরের স্বপ্ন আর কী। কিন্তু সেই থেকে নাকে শুধু শ্মশানের গন্ধ আসছে ডাক্তার। আমি কি পাগল হয়ে গেলাম ডাক্তার"?

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু