Monday, September 25, 2017

ফিলিপ্সের রেডিও

দাদুর একটা ফিলিপ্সের রেডিও ছিল। তিনটে বড় ব্যাটারির। এভারেডির লাল ব্যাটারি ছাড়া ভরসা করতে পারতেন না। প্রতি মাসে ব্যাটারি বদল করতে হত। গোটাদিনের সঙ্গী ছিল সেই রেডিওটা। এফএমে অভ্যস্ত হতে পারেননি। খবর শুনতেন। যে কোনও খেলার ধারাবিবরণী শুনতেন মন দিয়ে। আধুনিক, রবীন্দ্রসঙ্গীত,  অতুলপ্রসাদী, নজরুলগীতি, বাউল; কোন ফ্রিকুয়েন্সিতে কখন বাজবে, সে খবর রাখতেন। টপ্পা ভালোবাসতেন। হেমন্তকে ভালোবাসতেন। ধীরেন বসুর কণ্ঠস্বর পছন্দ করতেন। কবীর সুমনে সবিশেষ আগ্রহ ছিল।

দৃষ্টিশক্তি যত ক্ষীণ হয়েছে, দাদুর বই পড়া তত কমেছে। বেড়েছে রেডিও শোনা। মামাবাড়ি গেলেই আমার রাতের শোওয়ার ব্যবস্থা হত দাদুর পাশে। রাতে বহুক্ষণ খুব লো ভল্যুমে রেডিও চলত খাটের পাশে।

জানালার একটা পাল্লা খোলা থাকত, তা'দিয়ে স্ট্রিটল্যাম্পের ঘোলাটে আলো ঘরের মেঝেতে এসে পড়ত। মাঝরাতের রেডিওর মিনমিনে সুরে সে আবছা হলুদ আলো মিশে যেত দিব্যি।

কখনও অনেক রাতের দিকে ঘুম ভেঙেছে। তখন ঘরময় ঘোলাটে আলো। কোনও একটা ফ্রিকুয়েন্সিতে সে সময় প্রতি রাত্রে খেয়াল বাজত বোধ হয়। তখন বছরের এই সময়টায়; জানালার খোলা পাল্লা বেয়ে অল্প শীতের আমেজ এসে ঘরের বাতাসে  মিশে যেত। দাদুর একটা শাল আমার গায়ে জড়ানো থাকত। সেই ফিলিপ্সের রেডিও থেকে ভেসে আসা সুরের গুণ এমনই ছিল যে তা রাতের নিস্তব্ধতাকে নষ্ট করত না।

"জেগে গেলে নাকি ভাই"? রেডিওর খেয়ালের সঙ্গে দাদুর একটা হাত আমার কাঁধে এসে পড়ত। ঘুম না আসলে পাশে সরে এসে বলত;
"সুরে মন দাও, কেমন? সুরে মন দাও। খেয়াল করলে বুঝবে কেমন ভাবে সুর কান বেয়ে গলা দিয়ে বুকে নামে, তারপর হাত পা মাথায় ছড়িয়ে পড়ে, তাই না ভাই"?

ঘুমিয়ে পড়ার মুহূর্তের মধ্যে দাদু চিরকালের জন্য সুর মিশিয়ে দিয়ে গেছেন।

1 comment:

Rezwan said...

অসম্ভব ভাল লেগেছে। এই লেখাটা ইতিহাস হয়ে থাক। রেডিওর যুগ আর ফিরবেনা।