Skip to main content

ফিলিপ্সের রেডিও

দাদুর একটা ফিলিপ্সের রেডিও ছিল। তিনটে বড় ব্যাটারির। এভারেডির লাল ব্যাটারি ছাড়া ভরসা করতে পারতেন না। প্রতি মাসে ব্যাটারি বদল করতে হত। গোটাদিনের সঙ্গী ছিল সেই রেডিওটা। এফএমে অভ্যস্ত হতে পারেননি। খবর শুনতেন। যে কোনও খেলার ধারাবিবরণী শুনতেন মন দিয়ে। আধুনিক, রবীন্দ্রসঙ্গীত,  অতুলপ্রসাদী, নজরুলগীতি, বাউল; কোন ফ্রিকুয়েন্সিতে কখন বাজবে, সে খবর রাখতেন। টপ্পা ভালোবাসতেন। হেমন্তকে ভালোবাসতেন। ধীরেন বসুর কণ্ঠস্বর পছন্দ করতেন। কবীর সুমনে সবিশেষ আগ্রহ ছিল।

দৃষ্টিশক্তি যত ক্ষীণ হয়েছে, দাদুর বই পড়া তত কমেছে। বেড়েছে রেডিও শোনা। মামাবাড়ি গেলেই আমার রাতের শোওয়ার ব্যবস্থা হত দাদুর পাশে। রাতে বহুক্ষণ খুব লো ভল্যুমে রেডিও চলত খাটের পাশে।

জানালার একটা পাল্লা খোলা থাকত, তা'দিয়ে স্ট্রিটল্যাম্পের ঘোলাটে আলো ঘরের মেঝেতে এসে পড়ত। মাঝরাতের রেডিওর মিনমিনে সুরে সে আবছা হলুদ আলো মিশে যেত দিব্যি।

কখনও অনেক রাতের দিকে ঘুম ভেঙেছে। তখন ঘরময় ঘোলাটে আলো। কোনও একটা ফ্রিকুয়েন্সিতে সে সময় প্রতি রাত্রে খেয়াল বাজত বোধ হয়। তখন বছরের এই সময়টায়; জানালার খোলা পাল্লা বেয়ে অল্প শীতের আমেজ এসে ঘরের বাতাসে  মিশে যেত। দাদুর একটা শাল আমার গায়ে জড়ানো থাকত। সেই ফিলিপ্সের রেডিও থেকে ভেসে আসা সুরের গুণ এমনই ছিল যে তা রাতের নিস্তব্ধতাকে নষ্ট করত না।

"জেগে গেলে নাকি ভাই"? রেডিওর খেয়ালের সঙ্গে দাদুর একটা হাত আমার কাঁধে এসে পড়ত। ঘুম না আসলে পাশে সরে এসে বলত;
"সুরে মন দাও, কেমন? সুরে মন দাও। খেয়াল করলে বুঝবে কেমন ভাবে সুর কান বেয়ে গলা দিয়ে বুকে নামে, তারপর হাত পা মাথায় ছড়িয়ে পড়ে, তাই না ভাই"?

ঘুমিয়ে পড়ার মুহূর্তের মধ্যে দাদু চিরকালের জন্য সুর মিশিয়ে দিয়ে গেছেন।

Comments

Rezwan said…
অসম্ভব ভাল লেগেছে। এই লেখাটা ইতিহাস হয়ে থাক। রেডিওর যুগ আর ফিরবেনা।

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু