Skip to main content

সঞ্জীববাবু আর ভূত

সন্ধ্যে ৬টা ১০।
ড্রয়ার খুলে কবিতার ডায়েরীটা বের করলেন সঞ্জীববাবু।
 
 
রাত ১টা ১০।
গঙ্গার ঘাটে পৌঁছে পকেট থেকে রিভলভার বের করে হাতের মুঠোয় ধরে সামান্য আশ্বস্ত বোধ করলেন গোকুল চৌধুরী।
 
 
রাত ১টা ১৭।
চার নম্বর পাতা ছিঁড়ে চার নম্বর নৌকোটা বানিয়ে খানিক জিরিয়ে নিলেন সঞ্জীববাবু।
 
 
রাত ১টা ৪২।
রাতের এ দিকটায় বাতাসের ছ্যাঁতছ্যাঁতে শীতটা বাড়ে, গায়ের আলোয়ানটা শক্ত করে জড়িয়ে পায়চারীর গতি বাড়ালেন গোকুল চৌধুরী।
 
 
রাত ১টা ৫৭।
ডায়েরীটা পকেটে পুরে নিশ্চুপে ছাতের পাইপ বেয়ে বাড়ির পিছনের উঠোনে নেমে এলেন সঞ্জীব হালদার।
 
 
রাত ২টো ১২।
দূর থেকে হ্যারিকেনের আলোর দুলুনি চোখে পড়তেই গোকুলবাবুর হাতটা আপনা থেকে চলে গেল বাঁ পকেটে রাখা রিভলভারের বাটে।
 
 
রাত ২টো ১৭।
"ডায়েরীটা কই? একদম ওপর চালাকি নয়"।
 
 
রাত ২টো ২২।
গুলিটা লেগেছে পায়ে, শিশিরভেজা ঘাস কাদায় লুটোপুটি যাচ্ছিলেন সঞ্জীববাবু, তাঁর কানে গুড়ুম গুড়ুম শব্দে শুধু শোনা যাচ্ছিল "ওই চারটে কবিতা কই? কই ওই চারটে কবিতা?"।
 
 
রাত ২টো ৩৫, ১২ সেকেন্ড।
 
"চারটে কবিতা...চারটে কবিতা...ভেসে গেছে..."।
"সঞ্জীববাবু! আপনি কবি নন, ও চারটেয় এত লোভ"?
"অ-কবির কবিতা! আহ। তার মায়া"।
"যন্ত্রণা হচ্ছে?"
"হাঁটুর নিচে ঠিক। বড্ড"।
"আর আমারটা? সঞ্জীববাবু? আমার যন্ত্রণাটা?"।
"কবিতাগুলো আমার"।
"মানুষটা আমার"।
"মানুষ?"।
"নয়?"।
"ভূত। ভূতের ভয়। ভূতের কবিতা। আহ। যন্ত্রণা"।
"ভয় পান? তাঁকে?"।
"ভূতের ভয়। বললাম তো। বন্দুকে ভয় তেমন নেই গোকুলবাবু"।
"ওই কবিতাগুলো আমার চাই"।
"কেন? আপনি কি কবি?"।
"না, ভূতের বর।ভূত যার কবিতা তার"।
"ও। সে কবিতার কথা...জানলেন কী করে? সেও জানে না যে। আমার কবিতার ডায়েরীর খোঁজ কেউ জানে না"।
"ভূতেরা সব জানে। জোনাকিরা তাঁদের চোখ হয়ে উড়ে বেড়ায়, হুঁ হুঁ বাবা। ওপরচালাকি নয়"।
"ও কবিতায় কাঁচকলা আছে"।
"বাঙাল ভূত। ইলিশে কাঁচকলা ফেলে খায়"।
"কবিতা দেবেন? তাঁকে?"।
" না ভাসিয়ে দেব"।
"ওহ। ভেসেছে। তারা ভেসে গেছে"।
"ফের ধান্দাবাজি, এ'বার বাকি পাঁচটা বুকে ঠুকব"।
"কবিতার ওপর রাগ? আপনি উন্মাদ গোকুলবাবু"!
"অ-কবির কবিতার লোভের প্রতি রাগ। সে আমার"।
"আপনারই তো"।
"কবিতা ওয়াপিস দিন"।
"হয় না। সেগুলো তাঁর নয়"।
"মিথ্যে"।
"ভাসিয়েছি। চারটে কাগজের নৌকা। ওই দিকে"।
 
 
রাত তিনটে পাঁচ।
সঞ্জীববাবুর রক্ত নদীতে মেলানোর আগেই ডুবেছিল চারটে কাগুজে নৌকা। গঙ্গা ছাড়া সে কবিতাদের উপায়ন্তর ছিল না।
 
 
তখন ঘড়ির টিকটিক ছিল না।
 
- আপনি কবিতা লেখেন?
- পাগল?
- আপনি বরাবরই এমন? গা ঘিনঘিনে ন্যাকা? মেয়েলি?
- উফ!
- নাম দিয়ে যাই? 
- কার?
- আপনার না লেখা কবিতার।
- ধ্যের।
- কান মুলে শোনাব? না ভদ্রভাবে শুনবেন?
- ক..কান?
- এক নম্বর, এক ফালি মেঘ। দুই, এক ফোঁটা জল। তিন, রঙ ধনুকের একটি কণা!চার, একটি নিমেষ।
- এ তো...!
- চুপ! একটা জবরদস্ত ডায়েরী কিনবেন। কেমন? চামড়ার বাঁধাই, লাল বর্ডার, সোনালীতে লেখা পার্সোনাল ডায়েরী। কেমন? প্রথম চার পাতার মাথায় চারটে কবিতার নাম। মনে থাকবে?
- ধুস। যত্তসব। আমি আসি। আসি?
- আসুন। আমি আসি?
- আলবাত।
 
সন্ধ্যে ৬টা দশ।
ড্রয়ার খুলে কবিতার ডায়েরীটা বের করলেন সঞ্জীববাবু। চার পাতায় মাথায় চারটে লাইন।চারটে না-লেখা কবিতার নাম। চার পাতা জুড়ে রকমারি নৌকা আঁকা। সঞ্জীববাবু আঁকতে বড় ভালোবাসেন। সঞ্জীববাবু শুধু নৌকো আঁকতে পারেন। ডায়েরী খুললেই নূপুরের মিহি রিনরিন, খুব নরম; কান পাতলে তবেই অল্প চুইয়ে আসে।
 
রাত তিনটে পাঁচ।
ভূতের স্বপ্নে সে’দিন অজস্র নৌকোডুবি।
হুড়মুড়িয়ে সোজা ছাদে। নূপুরের মিহি রিনরিন। ছাতের উঁচু পাঁচিলের এ’দিকে নয়নতারার টবগুলো, পাঁচিলের ওপর থুঁতনি, ও পাশে গঙ্গা। আঁচলে, চুলে, সমস্ত এলোমেলো। নদীর অন্ধকারে চোখ নামালেন ভূত। 
 
 
***
 
সে দৃশ্যটাই ভাবতে ভাবতে সময় যখন অন্যমনা, 
সেই সময়ের শরিক হতেই আমার এমন কাঙালপনা। 
তোমার চোখেই আলোকবর্ষ করবে যখন গান রচনা,  
তখন তোমার রাত্রি ছুঁতেই আমার গানের ... কাঙালপনা। 

Comments

Popular posts from this blog

গোয়েন্দা গল্প

- কিছু মনে করবেন না মিস্টার দত্ত...আপনার কথাবার্তাগুলো আর কিছুতেই সিরিয়াসলি নেওয়া যাচ্ছে না।  - কেন? কেন বলুন তো ইন্সপেক্টর? - ভোররাতে এই থানা থেকে একশো ফুট দূরত্বে ফুটপাথে আপনাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায়।  - আপনার কনস্টেবল নিজের চোখে দেখেছে তো।  - না না, সে'টাকে আমি কোশ্চেন করছি না। আমি শুধু সামারাইজ করছি। আপনার গায়ে দামী চিকনের পাঞ্জাবী, ঘড়িটার ডায়ালও সোনার হলে অবাক হব না। এ'রকম কাউকে বড় একটা ফুটপাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যা হোক। হরিমোহন কনস্টেবলের কাঁধে ভর দিয়ে আপনি থানায় এলেন। জলটল খেয়ে সামান্য সুস্থ বোধ করলেন। অল ইজ ওয়েল। নিঃশ্বাসে অ্যালকোহলের সামান্যতম ট্রেসও নেই। শরীরে নেই কোনও চোট আঘাত।  - আমার কথা আমায় বলে কী লাভ হচ্ছে? আমি যে জরুরী ব্যাপারটা জানাতে মাঝরাতে ছুটে এসেছিলাম...সেই ব্যাপারটা দেখুন...। ব্যাপারটা আর্জেন্ট ইন্সপেক্টর মিশ্র।  - আর্জেন্সিতে পরে আসছি। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ আপনি থানায় ছুটে এসেছিলেন। ওয়েল অ্যান্ড গুড। কিন্তু...ফুটপাথে পড়ে রইলেন কেন...।  - এ'টাই, এ'টাই আমি ঠিক নিশ্চিত নই। মাথাটাথা ঘুরে গেছিল হয়ত। আফটার অল বা

পকেটমার রবীন্দ্রনাথ

১ । চাপা উত্তেজনায় রবীন্দ্রনাথের ভিতরটা এক্কেবারে ছটফট করছিল । তার হাতে ঝোলানো কালো পলিথিনের প্যাকেটে যে ' টা আছে , সে ' টা ভেবেই নোলা ছুকছাক আর বুক ধড়ফড় । এমনিতে আলুথালু গতিতে সে হেঁটে অভ্যস্ত । তাড়াহুড়ো তার ধাতে সয় না মোটে । কিন্তু আজ ব্যাপারটা আলাদা । সে মাংস নিয়ে ফিরছে । হোক না মোটে আড়াই ' শ গ্রাম , তবু , কচি পাঁঠা বলে কথা । সহৃদয় আলম মিয়াঁ উপরি এক টুকরো মেটেও দিয়ে দিয়েছে । তোফা ! নিজের লম্বা দাড়ি দুলিয়ে ডবল গতিতে পা চালিয়ে সে এগোচ্ছিল ।   গলির মোড়ের দিকে এসে পৌঁছতে রবীন্দ্রনাথের কেমন যেন একটু সন্দেহ হল । ঠিক যেন কেউ পিছু নিয়েছে । দু ' একবার ঘাড় ঘুরিয়েও অবশ্য কাউকে দেখা গেলনা । ভাবনা ঝেড়ে ফেলে মাংসের পাকেটটায় মন ফিরিয়ে আনলেন রবীন্দ্রনাথ । বৌ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে আজ । খোকাটাকে যে কদ্দিন মাংসের ঝোল খাওয়ানো হয়নি ।   খাসির রান্নার গন্ধ ভেবে বড় গান পাচ্ছিল রবীন্দ্রনাথের । সে বাধ্য হয়েই একটা কুমার শানুর গাওয়া আশিকি সিনেমার গান ধরলে ।

চ্যাটার্জীবাবুর শেষ ইচ্ছে

- মিস্টার চ্যাটার্জী...। - কে? - আমার নাম বিনোদ। - আমি তো আপনাকে ঠিক...। - আমায় বস পাঠিয়েছেন। - ওহ, মিস্টার চৌধুরী আপনাকে...। - বসের নামটাম নেওয়ার তো কোনও দরকার নেই। কাজ নিয়ে এসেছি। কাজ করে চলে যাব। - আসুন, ভিতরে আসুন। - আমি ভিতরে গিয়ে কী করব বলুন। সৌজন্যের তো আর তেমন প্রয়োজন নেই। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। চটপট কাজ মিটে গেলে পৌনে এগারোটার লোকালটা পেয়ে যাব। আমায় আবার সেই সোনারপুর ফিরতে হবে। - যা করার তা কি এ'খানেই সেরে ফেলা যায়না? - এমন কনজেস্টেড এলাকায় ও'সব কাজ করা চলেনা। চুপচাপ ব্যাপারটা সেরে ফেলতে হবে। - প্লীজ দু'মিনিটের জন্য ভিতরে আসুন বিনোদবাবু। জামাটা অন্তত পালটে নিই। - কী দরকার বলুন জামা পালটে। - দরকার তেমন নেই। তবু। ওই, লাস্ট উইশ ধরে নিন। - ক্যুইক প্লীজ। ট্রেন ধরার তাড়াটা ভুলে যাবেন না। আর ইয়ে, পিছন দিক দিয়ে পালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। বসের লোকজন চারপাশে ছড়িয়ে আছে। - ও মা, ছি ছি। তা নয়। আসলে মিতুলের দেওয়া একটা জামা এখনও ভাঙা হয়নি। বাটিক প্রিন্টের হাফশার্ট। একটু ব্রাইট কালার কিন্তু বেশ একটা ইয়ে আছে। ও চলে যাওয়ার পর ও জামার ভাজ ভাঙতে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু...আজ না হয়...। - মিতু